Wednesday, August 19, 2009
পাশ্চাত্যের মানুষ পুনরায় চারিত্রিক পবিত্রতার দিকে ঝুঁকছে
এক.
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সততা ও চারিত্রিক পবিত্রতাকে পছন্দ করে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানুষ যতই নৈতিক মূল্যবোধগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়, ততই তাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। পাশ্চাত্যে দীর্ঘকাল ধরে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় সেখানকার নারী, পুরুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। এ অবস্থায় সেখানকার নতুন প্রজন্মের কন্যা ও মেয়েরা পুনরায় চারিত্রিক পবিত্রতার দিকে ঝুঁকছে। তারা এখন অশ্লীলতা, ব্যাভিচার ও বিভিন্ন যৌন অনাচারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে।
পাশ্চাত্যের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ নারী সমাজের একটা অংশসহ তরুণী ও যুবতীদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার নামে যৌন অনাচার ও অশ্লীলতা প্রসারের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর বিরোধিতা করছে। যদিও পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমগুলো এ ধরনের তথ্য প্রচার করছে না, বরং বিপরীত তথ্যই প্রচার করছে। আই জি নামের নিউইয়র্ক-ভিত্তিক একটি জরীপ ও গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের নতুন প্রজন্মের মেয়েরা তাদের আগের প্রজন্মগুলোর পছন্দের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। অর্থাৎ সেখানকার এই প্রজন্মের মেয়েরা নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াতে এবং শরীরকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে মোটেই আগ্রহী নয়।
পাশ্চাত্যের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ নারী সমাজের একটা অংশসহ তরুণী ও যুবতীদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার নামে যৌন অনাচার ও অশ্লীলতা প্রসারের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর বিরোধিতা করছে। বরং তারা আধ্যাত্মিক ও আত্মিক চাহিদাগুলোর প্রতি বেশী গুরুত্ব দেয়ার দাবী জানাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখিকা ওয়েন্ডি শালিত বলেছেন, আমরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক স্পর্শকাতর সময়ের সম্মুখীন। পাশ্চাত্যে এখন ক্ষতিকারক সংগীত, বিভিন্ন ধরনের উস্কানীমূলক তৎপরতা, পরিবার ব্যবস্থায় ধ্বস, বিবাহ-বিচ্ছেদ, মাদকাসক্তি ও আদর্শিক অচলাবস্থা নারী ও কন্যাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বর্তমান প্রজন্মের যুবতী ও কন্যারা অতীতের প্রজন্মের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। তারা অবাধ বা লাগামহীন স্বাধীনতায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে, বরং তারা পুনরায় মানুষের প্রকৃতিগত সৎ-স্বভাব বা সতীত্বের মাধুর্য আস্বাদন করতে চাইছে।
মার্কিন লেখিকা ওয়েন্ডি শালিত আরো বলেছেন, পাশ্চাত্যের বর্তমান প্রজন্মের যুবতী ও কন্যারা তাদের বাবা মায়েদের মত হাল্কা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে চাইছে না। তারা তাদের পোশাকেও পরিবর্তন আনতে চাইছে। বরং তারা সংযম ও বিচক্ষণতা অবলম্বন করে সতীত্বকে যথাসম্ভব বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
মিসেস রাচেল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রথম দিকে আমি সতীত্বের গুরুত্বের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু সতীত্ব সম্পর্কে মার্কিন লেখিকা ওয়েন্ডি শালিতের বই পড়ে এখন আমার চোখ খুলে গেছে। আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে সঠিক পথ কোনটি। মহান প্রভুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে আমি সময়মত এ বই পেয়েছি। আমি এখন সতীত্ব বজায় রাখার জন্য নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি এবং আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছে আত্ম-বিশ্বাস।
পাশ্চাত্যের অনেক মানুষ এখন যৌন অনাচার ও ব্যাভিচারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেখানকার যুব প্রজন্মের যেসব সদস্য অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়িত হয়েছে তাদের দুই তৃতীয়াংশই এখন অনুতপ্ত। ২০০৫ সালে পরিচালিত অন্য এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিয়ের আগে যারা যৌন সম্পর্কে জড়িত হয়েছে এবং যারা মদ ও মাদক সেবনে অভ্যস্ত হয়েছে তারা যৌবনের এই সোনালী বয়সেই বিষন্নতা ও হতাশা বা নৈরাশ্যের শিকার। বিষন্নতার কারণে অনেক যুবতী শারীরীকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ ধরনের যুবতী ও তরুনীরা এখন সতীত্ব বজায় রাখতে না পারার জন্য অনুশোচনা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানাপলিস অঙ্গরাজ্যের ১৬ বছরের যুবতী লরেন অত্যন্ত কৃতী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত। সে এখন নাইট-ক্লাবের বিভিন্ন পার্টির প্রতি বিতৃষ্ণ। তার মতে চিত্ত-বিনোদনের নামে সমবয়সী ছেলে বন্ধুদের সাথে রাত না কাটিয়ে মেয়েদের উচিত সমবয়সী মেয়েদের সাথেই অবসর-বিনোদনকে গুরুত্ব দেয়া ।
২০০৬ সালে জগবি নামের খ্যাতনামা জরীপ সংস্থার এক জরীপে বলা হয়েছে, মার্কিন হাইস্কুলগুলোর দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের আচরণের ওপর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারী রাখাকে জরুরী বলে মনে করছে। তারা চায় বাবা-মায়েরা তাদেরকে খারাপ স্থানে বা ক্ষতিকারক আড্ডায় যেতে নিরুৎসাহিত করুক।
পাশ্চাত্যের কোনো কোনো স্থানের যুবক-যুবতীরা এখন ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সংযমী হবার প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ ক্লাসে তারা তাদের সম্ভাব্য সমস্যা ও সেগুলোর সমাধান নিয়ে আলোচনা বা পরামর্শ করার সুযোগ পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের অনেক যুবক-যুবতী এখন যৌন অনাচার ও ব্যাভিচারের বিস্তারের অন্যতম প্রভাবক বা চালিকা-শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত অশ্লীল ছায়াছবি, নাটক ও ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাদের অনেকেই এখন লেখক লেখিকাদেরকে তাদের গল্প বা চিত্র-নাট্য থেকে যৌন-সম্পর্ক বিষয়ক বক্তব্য বা দৃশ্যগুলো বাদ দেয়ার অনুরোধ করছে। তাদের অনেকেই এখন এসব অশ্লীল বিষয়কে বস্তাপচা বিষয় বলে মনে করছে এবং তারা বলছে, আমরা নতুন অথচ ভালো কিছু চাই।
আজকের এই আলোচনা শেষ করবো টেইলর ম্যুর নামের ১৮ বছর বয়স্ক এক মার্কিন যুবতীর বক্তব্য উদ্ধৃত কোরে। সংযম বিষয়ক প্রশিক্ষণ ক্লাসে অংশ গ্রহণকারী এই যুবতী তার সমবয়সী নতুন প্রজন্মের মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলছেন,
বন্ধুরা, সংযম খুবই ভালো কাজ। আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে চাই যে আমি চারিত্রিক পবিত্রতা বা সতীত্ব বজায় রেখেছি। আসুন আমরা সবাই মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থাকি। যৌন প্রবৃত্তিকে কেবল পরিবার গঠন ও মানুষের বংশ বিস্তার অব্যাহত রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সতীত্ব বা চারিত্রিক পবিত্রতা বজায় রাখা হলে মানুষের সত্তার সম্মান সব সময় বজায় থাকবে।
দুই.
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সততা ও চারিত্রিক পবিত্রতাকে পছন্দ করে। মানুষ যতই নৈতিক মূল্যবোধগুলোর মেনে চলে, ততই তাদের নিরাপত্তা বাড়ে। পাশ্চাত্যে দীর্ঘকাল ধরে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় সেখানকার নারী, পুরুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। এ অবস্থায় কন্যা ও মেয়েরাসহ সেখানকার নতুন প্রজন্মের অনেকেই পুনরায় চারিত্রিক পবিত্রতা এবং আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকছে।
পাশ্চাত্যের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ নারী সমাজের একটা অংশসহ তরুণী ও যুবতীদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার নামে যৌন অনাচার ও অশ্লীলতা প্রসারের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর বিরোধিতা করছে। যদিও পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমগুলো এ ধরনের তথ্য গোপন রেখে বিপরীত তথ্যই প্রচার করছে। আই জি নামের নিউইয়র্ক-ভিত্তিক একটি জরীপ ও গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের নতুন প্রজন্মের মেয়েরা নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াতে এবং শরীরকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ব্যবহৃত টাইট পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে মোটেই আগ্রহী নয়। আই জি প্রতিষ্ঠানের গবেষক মিলিসা লাভিজেন তার প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান ভিত্তিক এই রিপোর্ট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, নিউইয়র্কের নতুন প্রজন্মের মেয়েরা নিজেদের শরীর আগের চেয়েও বিস্তৃতভাবে ঢেকে রাখতে বা পোশাকে আবৃত করতে পছন্দ করছে। লাভিজেন আরো বলেছেন, আমাদের বিশ্বাস নিউইয়র্কের নতুন প্রজন্মের মেয়েদের এই পরিবর্তিত আচরণের মূল কারণ হল, লাগামহীন জীবন-যাত্রার প্রতি স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি। উল্লেখ্য, "সব কিছুই অস্থায়ী"-এই শ্লোগানের ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল লাগামহীন জীবন-যাত্রা। বর্তমানে এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে তরুণী ও যুবতীরা নিজেদের দেহ অতীত প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশী ঢেকে রাখছে বা পোশাকে আবৃত করছে। মিসেস লাভিজেনের মতে, পাশ্চাত্যে কয়েক দশক ধরে অশালীন বা অর্ধনগ্ন পোশাকের সংস্কৃতির আধিপত্যের পর এখন সেখানকার মানুষ আরো ভালো ও উন্নত পোশাক অনুসন্ধান করছেন।
আই জি প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্মের মেয়েরা অন্য যে কারনে তাদের আগের প্রজন্মগুলোর পছন্দের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন তা হল, বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা এবং আরো বেশী নিরাপত্তার প্রত্যাশা। এই গবেষকরা বলছেন, ধর্মের প্রতি আগ্রহ, গীর্যায় যাওয়া, লাগামহীন জীবন-যাত্রার গণ-সংস্কৃতির মোকাবেলা- এসব থেকে বোঝা যায় যুব-প্রজন্ম বর্তমান পরিস্থিতি বা পরিবেশের ওপর আরো ভালো নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান।
পাশ্চাত্যের অনেক যুবতী বা তরুণীর মধ্যে এই শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে যে, শালীন পোশাক ব্যক্তি ও সমাজের পবিত্রতা এবং সুস্থতার জন্য অপরিহার্য্য। যে পরিবেশে নারী ও কণ্যারা শালীনতার সীমা লংঘনে অভ্যস্ত নয়, সেখানে সহজেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা চালানো যায় বলে তারা বুঝতে পেরেছে। প্যানসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্ওয়ি হার্লি ২০০৬ সালের শরৎকালে আনুষ্ঠানিক পোশাকের পরিবর্তে যেমন-খুশি-তেমন পোশাক পরে ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিত হবার প্রতিবাদ জানান। তিনি কর্মস্থলে ও ক্লাসে আনুষ্ঠানিক শালীন পোশাক পরার প্রথা পুনরায় চালু করার আহ্বান জানিয়ে এক খোলা চিঠিতে বলেন, "শিক্ষার্থীদের পোশাক কি এমন হওয়া উচিত নয় যে তা থেকে পড়াশুনার প্রতি তাদের আন্তরিকতা বা আগ্রহ ফুটে উঠবে? আমার মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক পোশাক শিক্ষক, সহপাঠি এবং সর্বোপরি নিজের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন। শিক্ষার্থী যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক ও শালীন পোশাক পরে ক্লাসে উপস্থিত হয়, তখন তা এ অর্থ বহন করে যে সে এই শিক্ষা-বৈঠকের অন্য সদস্যদের সম্মান জানাচ্ছে এবং এ ধরনের বৈঠকে সে সবচেয়ে ভালো পন্থায় উপস্থিত থাকার অঙ্গীকার করছে।"
পাশ্চাত্যের কোনো কোনো তরুণী ও যুবতী অশালীন পোশাকের ব্যাপারে পোশাক-ব্যবসায়ী বা পোশাক মার্কেটের কর্মকর্তা, গণমাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় প্রতিবাদ-লিপি পাঠাচ্ছেন। এই তরুণী ও যুবতীরা শরীর-প্রদর্শনীমূলক বা অশালীন পোশাক পরতে রাজী নন।
এল্লা গান্ডারসন ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরের বাসিন্দা। ১৭ বছর বয়স্ক এই তরুণী সম্পতি আরো সংযত বা শালীন পোশাক সরবরাহ করতে নর্ডস্টর্ম নামের একটি পোশাক বিক্রয় কেন্দ্রে চিঠি লিখেছেন। তার ঐ চিঠি মার্কিন গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে এবং এর ফলে পোশাকের মডেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আবারও বিতর্ক জোরদার হয়ে উঠেছে। ঐ চিঠির একাংশে এল্লা গান্ডারসন বলেছেন, "নর্ডস্টর্মের সম্মানিত পরিচালক, আমি আপনার বিক্রয়-কেন্দ্রে এসেছিলাম পোশাক কিনতে। কিন্তু এখানে সব পোশাকই ছিল সংকীর্ণ ও শরীরকে দৃষ্টিকটুভাবে ফুটিয়ে তোলার পোশাক। আপনার বিক্রেতারা জানালেন, আমাদের কাছে কেবল এই এক ডিজাইনের পোশাক রয়েছে। যদি এ কথা সত্য হয়, তাহলে তো আমি বা অন্য যে কোনো মেয়েকে অর্ধনগ্ন পোশাক পরেই সড়গুলোতে চলা-ফেরা করতে হবে। আমার মতে, এ ধরনের প্রবণতা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। "
কয়েকমাস পর নর্ডস্টর্মের একজন প্রতিনিধি এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে বলে এল্লাকে নিশ্চয়তা দেন। অশালীন পোশাকের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের নতুন প্রজন্মের প্রতিবাদের মুখে কোনো কোনো পশ্চিমা বিক্রেতা কাঙ্ক্ষিত শালীন পোশাকের প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। এ ধরনের শালীন পোশাক প্রদর্শনীর ধারণা চালু হয় ১৯৯৯ সালে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল মা তাদের মেয়েদের দিয়ে এ ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই মেয়েরা ছিল একটি ধর্মীয় গ্রুপের সদস্য। ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের অংশগ্রহণে দেশটির ১৭ টি শহরে এ ধরনের শালীন পোশাকের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
সিয়াটলের ১৮ বছর বয়স্ক যুবতী রবিন মনে করেন, অশালীন পোশাক অন্যদেরকে এই পোশাকধারী সম্পর্কে বাস্তব ও মানবীয় মূল্যবোধের পরিবর্তে তার বাহ্যিক দিকের আলোকে বিচারের আহ্বান জানায়; আর এ বিষয়টি সমাজে নারীর মূল্যকে কমিয়ে দেয়।
এভাবে দেখা যাচ্ছ পাশ্চাত্যের নারী সমাজের নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীর শালীন পোশাক সম্পর্কে পশ্চিমা সমাজে একটা শক্ত অবস্থানের ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাই দেখা যাচ্ছে ম্যাগীর মত ৩৩ বছর বয়স্ক মার্কিন মহিলা সতীত্বের বা চারিত্রিক পবিত্রতার শিল্প শীর্ষক বই লিখে নারীর সম্মান বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে শালীন ও সম্মানজনক পোশাক পরার এবং পরপুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য সাজ-সজ্জা না করতে নারীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে পুরুষরা মানুষ হিসেবে নারীকে সম্মান জানায়।
পাশ্চাত্যের অনেক যুবক-যুবতী এখন যৌন অনাচার ও ব্যাভিচারের বিস্তারের অন্যতম প্রভাবক বা চালিকা-শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত অশ্লীল ছায়াছবি, কুরুচিপূর্ণ সঙ্গীত, নাটক ও ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে কয়েকজন তরুণী অশ্লীল ছবি প্রকাশের জন্য কয়েকটি ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ধর্মঘট পালন করে। পাশ্চাত্যের অনেক যুবক-যুবতী এখন নৈতিক সংযমের প্রশিক্ষণ-ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন।
এটা খুবই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যে, যেসব সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও বাবা-মায়েরা নিজ সন্তানদেরকে চারিত্রিক পবিত্রতার পথ থেকে দূরে থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন সেসব সমাজেরই যুব প্রজন্মের একাংশ উন্নত আদর্শের পথ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছেন। সাহসী এই যুব প্রজন্ম অন্যদের গভীরভাবে প্রভাবিত করছেন। নৈতিক সংযমের প্রশিক্ষণ-ক্লাসে অংশগ্রহণকারী রশীদা জলি'র মত ২৯ বছর বয়স্ক মার্কিন যুবতীর ভাষায় এই নতুন ধারা থেকে বোঝা যায়, সাহসী যুব-প্রজন্ম ইচ্ছে করলে প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত নেতিবাচক ধারার বিপরীত স্রোতে এগিয়ে যেতে পারে এবং এভাবে তারা এক ইতিবাচক উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারে।
এটা স্পষ্ট পাশ্চাত্যের অনেক মানুষ ও বিশেষ করে যুব প্রজন্মের একাংশ পুনরায় চারিত্রিক পবিত্রতার দিকে ঝুঁকছে, যদিও এ ধারার প্রতি সমর্থন এখনও ব্যাপক বা নিরংকুশ নয়, কিন্তু পশ্চিমা সমাজের নৈতিক সংকটসহ নানা সামাজিক সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সফল হয়েছেন। *
Wednesday, July 15, 2009
মারওয়া শেরবিনি হত্যাকান্ড : পাশ্চাত্যে ইসলাম আতঙ্কের ফসল
পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলমানদের প্রতি অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য নতুন কোন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে বসবাসরত মুসলমানদের মৌলিক অধিকার পদদলিত হয়ে আসছে। তবে সম্প্রতি জার্মানীর একটি আদালতে বিচারের শুনানী চলার সময়ে যে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে, তাকে পাশ্চাত্যে ইসলাম আতঙ্কের অন্যতম ফসল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঐ আদালতে এক বর্ণবিদ্বেষী তরুণ হিজাব পরিহিতা মিশরীয় গর্ভবতী নারী মারওয়া শেরবিনিকে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে এবং তার স্বামী তাকে বাঁচাতে আসলে পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়।
মিশরীয় নাগরিক মারওয়া শেরবিনি ২০০৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে স্বামীসহ জার্মানীতে পা রাখেন। সেখানে গিয়েই তিনি মুসলমানদের প্রতি জার্মান সমাজের বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন। ফার্মেসিতে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শেরবিনি নিজ জীবদ্দশায় জার্মান সমাজে ইসলাম বিদ্বেষ ও বর্ণবাদ কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সম্প্রতি জার্মানীর একটি পার্কে ঘুরতে গেলে তিনি বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হন। একজন বর্ণবিদ্বেষী জার্মান তরুণ শেরবিনি'র হিজাবকে সন্ত্রাসের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করে এবং তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। শেরবিনি ঐ যুবকের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করেন এবং সেখানে ঐ যুবকের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। আপীল আদালতে মারওয়া শেরবিনি যখন বিচারকের সামনে তাকে অপমান করার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, তখন অভিযুক্ত যুবক তার ওপর হামলা চালায়। 'তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই'- একথা বলে গর্ভবতী শেরবিনির ওপর সে উপর্যপুরি ১৮ বার ছুরিকাঘাত করে তাকে হত্যা করে। এ সময় শেরবিনির স্বামী তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে চাইলে জার্মান পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়। এসময় শেরবিনির ৩ বছরের শিশু আদালতে উপস্থিত ছিলো এবং ঐ অবুঝ শিশুর চোখের সামনে তার মা শহীদ এবং বাবা মারাত্মকভাবে আহত হয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যে জার্মান পত্রপত্রিকা অতি তুচ্ছ কোন ঘটনাকেও বড় করে তুলে ধরে, সেই গণমাধ্যম শেরবিনির হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কয়েকদিন ধরে রহস্যজনক নিরবতা পালন করে। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বলে দাবিকৃত এসব গণমাধ্যম কেবল তখনই শেরবিনির লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের খবর প্রচার করে যখন অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারী শেরবিনির হত্যাকান্ডের খবর জার্মানীর গণমাধ্যমে প্রকাশ না হওয়ার ঘটনা মুসলমানদের প্রতি জার্মানীসহ পশ্চিমা সমাজের বর্ণবাদী আচরণের বিষয়টি আরো একবার বিশ্ববাসীর সামনে ফুটিয়ে তুলেছে। এমনকি যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারীর হত্যাকান্ডের খবরটি প্রচারিত হয়েছে, তখনও জার্মান গণমাধ্যম এটিকে গুরুত্বহীন এবং একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। জার্মানীর এটর্নি জেনারেল মারওয়া শেরবিনির হত্যাকান্ড সংক্রান্ত যে কোন তথ্য প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেরবিনির জায়গায় যদি একজন অমুসলিম নিহত হতো, তবে পশ্চিমা গণমাধ্যম সে খবরকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতো এবং দীর্ঘদিন ধরে মাঠ গরম করে রাখতো। আলজেরিয়ার আশশুরুক পত্রিকার সম্পাদক যেমনটি বলেছেন,"মুসলিম নারীর পরিবর্তে জার্মানীতে যদি কোন ইহুদী এরকম নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হতো, তবে জার্মান পত্রিপত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে হৈ চৈ ফেলে দিতো।" জার্মানীর আদালতের বিচারক ও পুলিশের চোখের সামনে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার মুসলিম নারী মারওয়া শেরবিনির ভাই তারেক শেরবিনি এ সম্পর্কে আল আলম নিউজ চ্যানেলকে বলেছেন, "যদি ঐ হত্যাকান্ড কোন ইউরোপীয় বা পশ্চিমা নাগরিকের ওপর পরিচালিত হতো, তবে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এলাহী কান্ড ঘটে যেতো। কিন্তু আমার বোনের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তারা আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করেছে। এটি সকল আরব ও মুসলমানকে অবমাননার শামিল।"
প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, দেশগুলোর গণমাধ্যম হুবহু সে নীতি অনুসরণ করছে। এসব সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছে এবং বহু পশ্চিমা রাষ্ট্রনায়ক তাদের কথাবার্তায় ইসলাম বিদ্বেষের বিষয়টি চেপে রাখতে পারেন নি। পাশ্চাত্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক, বিশেষ করে হিজাবের বিরুদ্ধে এক ধরনের চরম বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমনকি হিজাব পরার কারণে মিশরীয় মুসলিম নারী মারওয়া শেরবিনিকে হত্যা করেছে। বর্তমানে জার্মানীর বেশ কয়েকটি প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী অফিস আদালতে হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। ফ্রান্সেও মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরিধানের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখা হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম বিদ্বেষ এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিক অধিকার বিষয়ক সংস্থা এফ.আর.এ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে গত এক বছরে বণবদী আচরণের পরিমাণ শতকরা ৮০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দেশের শীর্ষে রয়েছে বৃটেন। ২০০৭ সালে বৃটেনে ৬১টি বর্ণবাদী হামলা হয়েছিলো। এ দৃষ্টিকোন থেকে জার্মানীর আদালতে একজন মুসলিম নারীর হত্যাকান্ড অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা নয়। কারণ, জার্মানীসহ পশ্চিমা দেশগুলোর গণমাধ্যম সেসব দেশে মুসলিম বিদ্বেষী পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। জার্মানীর একটি প্রাদেশিক পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য জামাল কারযুলি এ সম্পর্কে বলেছেন, "জার্মানীর রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমগুলো বহু বছর আগে থেকে দেশটিতে একটি ইসলাম বিদ্বেষী পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জার্মানীর আদালতে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলার হত্যাকান্ডের ঘটনায় দেশটির সরকার নিজেকে নির্দোশ ভাবতে পারে না। বিশেষ করে মারওয়া শেরবিনির হত্যাকান্ডের ব্যাপারে বহু প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। প্রকাশ্য আদালতে এ ধরনের ঘটনা ব্যাপক সংশয়েরও জন্ম দিয়েছে। কারণ, জার্মানীর আইন অনুযায়ী আদালতে জননিরাপত্তাকে হুমকিগ্রস্ত করা যায় এমন কোন ধরনের অস্ত্র বা গোলাবারুদ নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। আদালতে প্রবেশের সময় প্রতিটি ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করে তার নিরস্ত্র হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয় কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় শেরবিনির ঘাতক কীভাবে ছোরা নিয়ে আদালতে প্রবেশ করলো- এটি হচ্ছে প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের চোখের সামনে এতবড় একটি হত্যাকান্ড ঘটার সময় পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো কেনো? পুলিশ শেরবিনিকে রক্ষা করতে এগিয়ে না এসে বরং তার স্বামীর গায়ে গুলি করে। তারা ঐ ঘাতক যুবককে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে পারতো। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, বর্ণবিদ্বেষী জার্মান সমাজে আর কোন মুসলিম নারী যাতে হিজাব পরার সাহস না দেখায় সেজন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শেরবিনি'র হত্যাকান্ডের নাটক আদালতে মঞ্চস্থ করা হয়েছে।
বর্ণবাদী হামলার শিকার মারওয়া শেরবিনি আসলে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিজাব পরতেন। এ কারণে মিশরের ঐ নারীকে 'শহীদে হিজাব' বা হিজাবের শহীদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিজাব হচ্ছে এমন এক ঢাল যা নারীকে লম্পট পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। হিজাব পরিধান করে একজন নারী নিরাপত্তা সহকারে সমাজের গঠনমূলক কাজে অংশ নিতে পারে। মারওয়া শেরবিনি ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে শহীদ হওয়ার কারণে বিশ্বের মুসলমানরা তার প্রতি সহমর্মীতা প্রকাশ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ধিক্কার জানিয়েছে। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় শেরবিনির জন্মস্থানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে তার জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ইরানেও তার প্রতীকি দাফন সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি জার্মানী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি ইতালির রাষ্ট্রদূতকে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে শেরবিনির নিজ দেশ মিশর সরকারের অদ্ভুত নীরবতা দেশটির জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। মিশরের অনেক আলেম ও রাজনৈতিক নেতা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ আবুল গেইতের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম বিদ্বেষী যে পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, তার ফলে মুসলমানরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যম এসব দেশে ইসলাম গ্রহণের ক্রমবর্ধমান হার রোধ করার লক্ষ্যে ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে। ইসলাম মানুষের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হওয়ার কারণে বহু মানুষ এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। হিজাব বা ইসলামী শালীন পোশাক হচ্ছে এ ধর্মের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। কিন্তু সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য এই হিজাবকে পশ্চিমা দেশগুলো মেনে নিতে রাজী নয়। পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার রক্ষার দাবি করলেও বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে নানাভাবে ইসলামের অবমাননা করছে। এসব দেশ তাদের মতাদর্শ বিরোধী কোন দেশের সামান্য ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ ফেলে দিতে সিদ্ধহস্ত হলেও প্রকাশ্য আদালতে একজন মুসলিম নারীর হত্যাকান্ডে কোনরকম বিচলিত হয় নি। মানবাধিকারের পৃষ্ঠপোষক এসব দেশের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী হামলায় একজন গর্ভবতী নারীর করুণ মৃত্যুতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় নি।#
Tuesday, April 21, 2009
পশ্চিমা সমাজে নৈতিক অধঃপতনের বিস্তার
পাশ্চাত্যে যৌন অনাচার ও নৈতিক অধঃপতনের বিস্তারে সমাজ-বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তালাকের হার বৃদ্ধি, পরিবার ব্যবস্থায় ধ্বস, লিভ টুগেদার বা অবৈধভাবে স্বামী-স্ত্রীর মত জীবন যাপন, ব্যাভিচার এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে অশ্লীলতার মত সংকটের বিস্তারে পাশ্চাত্যের সরকারী পরিকল্পনাবিদরাও শঙ্কিত। পাশ্চাত্যে নৈতিক অধঃপতন এতটা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে যে সেখানে অযাচার বা পরিবারের যেসব সদস্যের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের সাথেও ব্যাভিচারের ঘটনা বাড়ছে।
কয়েক মাস আগে অস্ট্রিয়ায় এ ধরনের একটি ঘটনা ফাঁস হয়েছে। দেশটিতে জোসেফ ফ্রিটজেল নামের ৭২ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি নিজের কন্যাকে বিগত ২৪ বছর ধরে একটি ভূগর্ভস্থ স্যাতস্যাতে কক্ষে আটক করে রেখেছিল। শুধু তাই নয় এই নির্দয় পিতা নিজ কন্যার শ্লীলতাহানি করে সাতটি সন্তানের জনক হয়েছে। সম্প্রতি বৃটেন ও ইতালীতেও এ ধরনের ঘটনা ফাঁস হয়েছে। ইতালীতে এক পিতা তার কয়েক জন কন্যার সম্ভ্রমহানি করেছেন, এমনকি নিজের এক পুত্র সন্তানকেও এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে অংশ নিতে উৎসাহ দিয়েছেন। কলম্বিয়াতেও এক নরপশু তার এক কন্যাকে নয় বছর বয়স থেকে দীর্ঘ ২১ বছর পর্যন্ত পাশবিকতার শিকারে পরিণত করে ১১ টি সন্তানের জন্ম দিয়েছে । এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, পাশ্চাত্যের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জীবন-ব্যবস্থাও এখন হুমকির মুখে।
পাশ্চাত্যে নৈতিকতার অবক্ষয় এবং আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাবার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যেই সূচিত হয় রেনেসাঁর যুগে। ঐ যুগে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদরা গীর্যার কর্তৃত্ব খর্ব করার পাশাপাশি ধর্মকেও কোনঠাসা বা একঘরে করে। ফলে পাশ্চাত্যে ধীরে ধীরে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ এবং এ সংক্রান্ত সীমারেখাগুলো পদদলিত হতে থাকে। ১৯৬০'র দশকে পাশ্চাত্যে নগ্নতা, অশ্লীলতা ও যৌণ-অনাচার ব্যাপকতা লাভ করে। এর আগে নৈতিকতার সীমানাগুলো সমাজের নৈতিক ও মানসিক সুস্থতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপনে নগ্নতা ও অশ্লীলতার প্রচারের ফলে এইসব সীমারেখা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের প্রসারের পাশাপাশি বিস্তার ঘটে স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসঘাতকতা, তালাক, বিবাহ ছাড়াই স্বামী-স্ত্রীর মত একসাথে জীবন যাপন ও সমকামিতার মত জঘন্য পাপাচার। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয়ের ঐ জোয়ারের সময়ই অনেক চিন্তাবিদ যৌন অনাচার ও লাগামহীনতার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। ষাটের দশকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী নৈতিক অবক্ষয়ের এই সংকটের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন," ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুব-প্রজন্ম আরামপ্রিয় ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। এরা যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়-চিত্ত নয়। এদের প্রতি সাত জনের মধ্যে ছয় জনই অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়-বিলাসিতার কারণে শারীরীক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আমি আগামী প্রজন্মের মার্কিনীদের জন্য গভীরভাবে শঙ্কিত।"
অবশ্য কেনেডীর ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়েও মার্কিন সমাজের পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বই-পুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটসহ সমস্ত গণমাধ্যম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লাগামহীন যৌণাচার বা ব্যাভিচারের প্রচার-প্রসারের কাজে নিয়োজিত। এইসব গণমাধ্যম পারিবারিক বন্ধন ও স্বামী-স্ত্রীর বৈধ ভালবাসার সম্পর্ককে ধ্বংসের কাজে এতটা সফল হয়েছে যে এসব মূল্যবোধ কেবল বদলে গেছে তা নয়, বরং পুরোপুরি উল্টে গেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ফরাসী চিন্তাবিদ ডক্টর এ্যালেক্সিস কার্ল লিখেছেন, আমরা সমস্ত ঘরোয়া মূল্যবোধকে ধর্মীয় বিধানের মতই নির্মূল করেছি। আজকের নতুন প্রজন্ম অতীতের ঐসব মূল্যবোধ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। সংযম, চারিত্রিক পবিত্রতা বা সততা, বন্ধুত্ব, দায়িত্বশীলতা, আত্মশুদ্ধি বা আত্মিক পবিত্রতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা, চারিত্রিক বা নৈতিক মহত্ত্ব -- এ সবই এখন অর্থহীন শব্দ মাত্র এবং আজকের যুব সমাজের কাছে পরিহাসের বিষয়।
ইরানী লেখক মাহমুদ হাকিমী "অসুস্থ পশ্চিমা সমাজ " শীর্ষক বইয়ে একটি মার্কিন ম্যাগাজিনের উদ্বৃতি দিয়ে লিখেছেন, শয়তানের তিন ধরনের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের বিশ্বটাকে ঘেরাও করেছে। প্রথমতঃ অশ্লীল সাহিত্য এবং পর্দাহীনতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর্দাহীনতা অত্যন্ত বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রচলন অব্যাহত থাকে। এই লজ্জাহীনতা বা বেহায়াপনা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ চলচ্চিত্র বা ছায়াছবিগুলো মানুষের মধ্যে অশালীনতা ও ইন্দ্রিয়পরায়নতা বৃদ্ধি করেছে এবং এ ধরনের অনৈতিক আচরণের বাস্তব পথ বা পন্থাও শিখিয়ে দিচ্ছে। তৃতীয়তঃ সাধারণ মহিলাদের মধ্যে পোশাক পরার ক্ষেত্রে কুরূচি বা অশ্লীলতা ও এমনকি নগ্ন হওয়া এবং পুরুষদের সাথে অবাধ মেলা-মেশার প্রচলন।
পাশ্চাত্যে মহিলাদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের উস্কানী। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণরা শৈশব থেকে কৈশর পর্যন্ত কেবল টেলিভিশনের পর্দায় সম্ভ্রমহানির কয়েক হাজার দৃশ্য দেখে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে বহু মহিলা কর্মস্থলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পথে-ঘাটে সম্ভ্রমহানির শিকার হন। দেশটির শতকরা ২০ ভাগ মহিলা নিজ বন্ধুদের পাশবিক হামলার শিকার হন। এ ধরনের মার্কিন নারীদের মধ্যে শতকরা ৬১ জনের বয়স ১৮ বছরেরও কম এবং শতকরা ২৯ জনের বয়স ১১ বছরেরও কম। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮ থেকে ১৯ বছর বয়স্ক ২১০ নারীর সম্ভ্রমহানির দায়ে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এ ধরণের ভয়াবহ খবর মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৭ সালে বৃটেনের ১৫ বছর বয়সী ৫০ হাজার কিশোরী গর্ভপাত ঘটানোর জন্য চিকিৎসালয়ে ধর্ণা দিয়েছে। পাশ্চাত্যে ধর্ষণের শিকার অনেক মহিলাই পুলিশের কাছে সম্ভ্রমহানির কথা জানান না। অনেক নারী চিরজীবন এ দুঃখ মনের মধ্যেই গোপন রাখেন। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ দেশগুলোতেও নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে।
বৃটেনে প্রতি ৫ জন মহিলা পুলিশের মধ্যে চার জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের সময় যৌণ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বিখ্যাত মার্কিন লেখক অধ্যাপক উইলিয়াম মার্কিসন লিখেছেন, স্বামী-স্ত্রীর সুশৃঙ্খল বা সুস্থ যৌন সম্পর্ক বাদ দিয়ে আমরা প্রাণঘাতি এইডস ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের শিকার হয়েছি। আমরা বিয়ের সম্পর্ক ত্যাগ করে তালাককে উন্নত জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছি। গর্ভপাতকে অপরাধ মনে না করে এ কাজকে এখন আমরা মানবাধিকার বলে মনে করছি এবং এ কাজকে ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতার গৌরবময় লক্ষণ বলে ধরে নিয়েছি।
এভাবে পশ্চিমা সমাজে নৈতিক অধঃপতন ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা সভ্যতার অগ্রগতি এবং সেখানকার আরাম-আয়েশের জীবন খুব ভালোভাবে তুলে ধরলেও সেখানকার নৈতিক অবক্ষয়ের কথা তৃতীয় বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই এড়িয়ে যান, বা সে বিষয়কে গুরুত্ব দেন না। বরং তারা নিজ দেশেও সবক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের জন্য প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটও যুক্ত হওয়ায় পশ্চিমা সভ্যতার পতন আরো এগিয়ে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় সাবেক কংগ্রেস সদস্য বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের দাবী থেকে দেশটির নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বলেছেন,
" হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে হবে। কিন্তু যে দেশটিতে ১২ বছরের বালিকারা গর্ভ ধারণ করে, ১৫ বছর বয়স্করা একে-অপরকে হত্যা করে, ১৭ বছর বয়স্করা এইডস রোগে আক্রান্ত হয় এবং ১৮ বছর বয়স্করা ডিপ্লোমা লাভ করা সত্ত্বেও লিখতে ও পড়তে পারে না, তারা কারোরই নেতৃত্ব দিতে সক্ষম নয়। "
Tuesday, March 3, 2009
পাশ্চাত্যে পারিবারিক কাঠামো ধ্বংসের প্রচেষ্টা
পশ্চিমা চিন্তাবিদগণ বহুদিন যাবত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কিছু সংকটের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন যেগুলোর অধিকাংশই নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমা সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে, সেখানে পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। লিবারেলিযম বা কথিত উদার নৈতিকতার নামে এমন সময় পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, যখন সমাজের অন্যতম ভিত্তিই হচ্ছে পরিবার। অবস্থা এমন উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, কোন কোন পশ্চিমা চিন্তাবিদ এর কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বই লিখে ফেলেছেন।
The War Against The Family 'দ্যা ওয়ার এ্যাগেইনস্ট দ্যা ফ্যামিলি' বা 'পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নামের বইটিতে পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কানাডার চিন্তাবিদ উইলিয়াম গার্ডনার (William Gairdner) এ বইয়ের লেখক। এ বইটি শুরু করা হয়েছে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ফিশার এইমসের (Fisher Ames) একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়ে। এতে বলা হয়েছে, "আমরা এখন গণতন্ত্র নামের এমন একটি চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি যেখানে নাগরিকদের স্বাধীনতাকে হত্যা করার আগে তাদের চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।" ঊনবিংশ শতাব্দির মার্কিন লেখকের এই উদ্ধৃতিটি প্রমাণ করে, গণতন্ত্র- কথিত স্বাধীনতার নামে যে পশ্চিমা জনগণের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিয়েছে তাই নয়, সেই সাথে তাদের চরিত্র নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
উইলিয়াম গার্ডনার তার বইয়ের শুরুতে পরিবার সম্পর্কে বলেছেন, "পিতা, মাতা ও সন্তানের সমন্বয়ে যে পারিবারিক কাঠামো গঠিত হয়েছে তার রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য। পারিবারিক কাঠামোকে কী পরিমাণ অবহেলা করা হচ্ছে তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ এ পর্যন্ত মানবাধিকার, নারী অধিকার ও শিশু অধিকারসহ আরো বহু অধিকার আদায় করার জন্য আইন প্রণয়নসহ আরো বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পারিবারিক অধিকার রক্ষা বা পারিবারিক কাঠামো রক্ষার কথা কাউকে বলতে শোনা যায় নি। 'পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শীর্ষক বইয়ে পরিবার ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের জন্য পশ্চিমা সরকারগুলোকে দায়ী করা হয়েছে।
গার্ডনার মনে করেন, পশ্চিমা সরকারগুলো চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপের দিক দিয়ে সাবেক কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোর পর্যায়ে চলে গেছে। সুদূর অতীতকাল থেকে সমকামীতা একটি চরম জঘন্য ও ঘৃনিত বিষয় বলে বিবেচিত হয়ে আসলেও বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে এ বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সমকামীদের কথিত অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। অনেক পশ্চিমা দেশে সমকামীদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে এবং গর্ভপাতকেও বৈধতা দেয়া হচ্ছে। গার্ডনার তার বইয়ে এক্ষেত্রে বৃটিশ লেখক এ্যালডাস হ্যাক্সলির (Aldus Haxly) একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন। হ্যাক্সলি বলেছেন, "পশ্চিমা দেশগুলোতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকার কারণে যে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়ার জন্য অবাধ যৌন স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।" অর্থাৎ পশ্চিমারা নিজেদেরকে স্বাধীনতার প্রবক্তা বলে দাবি করলেও তারা যে তাদের জনগণকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিতে পারে নি, সেকথা পশ্চিমা ঐ লেখকের কথায় ফুটে উঠেছে।
গার্ডনার এ সম্পর্কে বলেছেন, যৌন স্বাধীনতা পশ্চিমা সরকারগুলোর জন্য এমন একটি অস্ত্রে পরিণত হয়েছে যা দিয়ে তারা নৈতিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। তিনি বলেন, কোন নিয়ম-নীতি যখন সরকারের পক্ষ থেকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন কিছুদিন এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলে ধরা হয়। অনেক সময় এ ব্যাপারে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাও চলে যেটা পশ্চিমা সমাজে বর্তমানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে সমাজ ধ্বংসের মাধ্যমে সরকারের চাপিয়ে দেয়া নীতির দৈন্যতা ফুটে উঠবেই।
উইলিয়াম গার্ডনারের মতে, মূলত পশ্চিমা সরকারগুলো পারিবারিক কাঠামো ধ্বংসের জন্য দায়ী হলেও সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়ও এজন্য দায়ী। এক্ষেত্রে তিনি পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। স্কুলের কোমলমতি শিশুদেরকে পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে বেড়ে ওঠার শিক্ষা দেয়া উচিত হলেও দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের কোন পাঠ্য নেই। "পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" শীর্ষক বইয়ে পাশ্চাত্যের স্কুলগুলোর ভয়াবহ চিত্রের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানকার স্কুলে এলকোহল ও মাদক সেবন, আগ্নেয়াস্ত্র বহন এবং যৌন অনাচার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে উল্লেখ করে গার্ডনার প্রশ্ন করেছেন, এমন অবস্থা সৃষ্টি হলো কেন? এরপর এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতাকে গুরুত্বহীন বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং কোমলমতি সন্তানদেরকে পিতামাতার সাথে বেয়াদবী করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
গার্ডনারের বইয়ে আরো বলা হয়েছে, পাশ্চাত্যের স্কুলগুলোতে যৌনশিক্ষা বলে যে পাঠ্য চালু করে দেয়া হয়েছে, তা কোমলমতি শিশুদের যৌনাচারে উস্কে দিচ্ছে। কথিত ঐ যৌনশিক্ষা বিয়ে, পরিবার ও সমাজ ধ্বংসের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গার্ডনার আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, যৌনশিক্ষার নামে স্কুলে যা শেখানো হচ্ছে, তাতে বাচ্চাদের আর পর্নোগ্রাফি দেখার প্রয়োজন নেই। বয়ো:সন্ধিকালে শিশুরা আগে যেখানে পিতামাতার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতো, যৌনশিক্ষার মাধ্যমে এখন আর তারা সে প্রয়োজন অনুভব করছে না, নিজেরাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে পরিচালিত জনমত জরীপে দেখা গেছে, কথিত যৌনশিক্ষা চালু থাকার পরও অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ, গর্ভপাতসহ এ ধরনের অনৈতিক কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ার পরিবর্তে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কানাডিও লেখক গার্ডনারের মতে, পারিবারিক কাঠামো ধ্বংসের আরেকটি কারণ হচ্ছে ফেমিনিযম বা কথিত নারীবাদী আন্দোলন। তিনি এক্ষেত্রে উগ্র নারীবাদীদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যারা স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স গ্রহণ করে নারীদের সমকামী হতে উস্কে দিচ্ছে এবং তাদেরকে মা হতে নিষেধ করছে। তিনি নারীবাদীদের এ কাজের তীব্র বিরোধিতা করেন। গার্ডনার সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য হলেও সংসারে তাদের উপস্থিতি এবং সন্তান লালন পালনে তাদের ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশী উপকারী বলে মনে করেন। তিনি বলেন, আমি অতি খারাপ মায়ের চেয়ে শিশুদের ডে কেয়ার সেন্টারে পাঠানোকে শ্রেয় মনে করবো। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, একজন সাধারণ মায়ের জায়গা কেউই পূরণ করতে পারে না, আর মা যদি ভালো হয়, তাহলেতো আর কথাই নেই।
উইলিয়াম গার্ডনার স্বাভাবিক ও ঐতিহ্যগত পারিবারিক কাঠামোর জন্য সমকামিতা এবং সমকামীদের মাধ্যমে পরিবার গঠনকে মারাত্মক হুমকি বলে মনে করেন। সমকামী আন্দোলনকারীরা যে সব লোকভোলানো কথা বলে, বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তা খণ্ডন করে তিনি বলেন, এই অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক যৌনাচার পরিবার, সমাজ- এমনকি সমকামীদের নিজেদের জন্যও বিপদজনক ও ক্ষতিকর। পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শীর্ষক বইয়ে পশ্চিমা সমাজের আরো যেসব অনাচারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তার মধ্যে গর্ভপাতের মাধ্যমে অঘোষিত জাতিগত শুদ্ধি অভিযান অন্যতম। গার্ডনার গর্ভপাতকে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে মনোরম প্রচারণার মাধ্যমে এ কাজে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, "একজন নারী ও একজন পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সন্তান ধারণের মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবার গঠন করেন। কিন্তু সমকামীরা যে কথিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় সেটা দুই পুরুষই হোক কিংবা দুই নারী- তাকে কোনভাবেই স্বাভাবিক পরিবার বলা চলে না। এছাড়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই দুই নারী পুরুষের একত্রে থাকাকেও পরিবার বলা যায় না, কারণ, এখানে কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই।
গার্ডনার তার বইয়ের শেষাংশে বলেছেন, পারিবারিক কাঠামোর ওপর যত হামলাই চালানো হোক না কেন, এ কাঠামো টিকে থাকবে। কারণ, পাশ্চাত্যে লোকভোলানো যেসব শ্লোগান দিয়ে পরিবার ধ্বংসের চক্রান্ত করা হচ্ছে, তা বেশীদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তিনি সুস্থ মস্তিস্কসম্পন্ন বিবেকবান মানুষদের পারিবারিক কাঠামো রক্ষার কাজে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।#
Friday, January 2, 2009
গাজা ও কারবালার শাহাদতের সংস্কৃতি
বর্ষ-পরিক্রমায় আবারও ফিরে এসেছে বুকের বেদনায়-ঢাকা মহররম মাস ও রক্তের আখরে লেখা আশুরা-বিপ্লবের শিহরণ-জাগানো দিনগুলো। দিকে দিকে আবারও শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত ও ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মুক্তিকামী মানুষের নেতা চিরউন্নত-শির হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)'র চিরঅক্ষয় নাম। ইসলামের এই ত্রাণকর্তা ও মহান ইমাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের চির-উজ্জ্বল, চির-সুন্দর এবং প্রেমময় দৃষ্টান্ত। আত্মত্যাগের ইতিহাসে তিনি কালোত্তীর্ণ ও চিরসবুজ প্রতীক। মুক্তিকামী মানুষের নয়নমনি ও নিপীড়িত মানুষের ধ্যানের ছবি ইমাম হোসাইন (আঃ) ধর্ম, মানবিকতা, বিবেক, মনুষ্যত্ব, মর্যাদাবোধ এবং যুক্তি, সত্য, মহত্ত্ব ও সর্বপরি খোদা-প্রেমের সবগুলো মানদন্ডে মানবজাতি ও মানবইতিহাসের নজিরবিহীন মডেল। প্রায় ১৪০০ বছর আগে সত্যের পক্ষে মৃত্যুবরণ করে তিনি শুধু ইসলাম ধর্মেরই নয় একইসাথে মানবজাতির মর্যাদা রক্ষা করেছেন। তিনি শিখিয়ে গেছেন মুক্তির এই মহামন্ত্র যে,
"যতদিন থাকবে ধরায় আত্মদান
অত্যাচারীর খড়গ-কৃপানে মানবতা হারাবে না সম্মান
জেগে ওঠে ইসলাম পুণরায়
জগতের প্রতিটি কারবালায়।"
সত্যের পক্ষে আত্মদান যে বৃথা যায় না, বরং তা যে সমাজের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা তাগুতি শক্তিকে নির্মূল করার এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা জুলুম, অত্যাচার, দুর্নীতি, অবিচার, ভীরুতা, আপোসকামীতাসহ সমস্ত পাপ-পংকিলতার মূলোৎপাটনের মহৌষধ তারই প্রমাণ আশুরার এই মহাবিপ্লব। শাহাদতে যে গোটা সমাজকে মুক্তিপাগল ও বিশুদ্ধ-আদর্শকামী করে তোলার মোক্ষমতম পন্থা মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে অক্ষয় আসনের অধিকারী ইমাম হোসাইন সহ তাঁর প্রকৃত অনুসারীরা তা যুগে যুগে প্রমাণ করেছেন। তারা দেখিয়ে গেছেন শাহাদতেই রয়েছে প্রকৃত জীবন তথা মর্যাদার জীবন, আর অন্যায়ের সাথে আপোস করে বেঁচে থাকার মধ্যে রয়েছে বঞ্চনা ও অবমাননার দুঃসহ গ্লানি। শাহাদতের চির-অম্লান আইকন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন কবির এই অমর বাণীঃ
জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনই জানি
শহীদী রক্ত হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানী।
ইসলামের মহান খেলাফত ও ইসলামের অস্তিত্ব যখন মুসলিম নামধারী জালেম এবং তাগুতি শক্তির হাতে পুরোপুরি বিলুপ্তির সম্মুখীন ইসলাম ও মানবতার সেই মহাদূর্দিনে নিজ আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আশুরা বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) বলেছিলেন, " তোমরা কি দেখছো না সত্যের বা ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা হচ্ছে না এবং কেউই অন্যায়ের বিরোধিতা করছে না? এ অবস্থায় এমন লাঞ্ছনার জীবনের চেয়ে একজন বিশ্বাসী বা মুমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর সাথে মিলন তথা শাহাদতই বেশী কাম্য। "
ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম প্রচারের অন্যতম প্রধান অগ্রদূত ও বিশিষ্ট ইরানী সূফী সাধক হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রঃ) হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)'র কালজয়ী বিপ্লবের প্রশংসা করে বলেছেন, হোসাইনই ধর্ম এবং ধর্মের রক্ষাকর্তা, তিনিই লা-ইল্লাল্লাহর ভিত্তি বা বুনিয়াদ রক্ষাকারী, শির দিয়েছেন, তবুও ইয়াজিদের হাতে হাত দেন নি বা ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করেন নি।
শাহাদত জীবনকে দেয় অপার মহিমা। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, যাঁরা আল্লাহর পথে শহীদ তাঁদের মৃত বলো না। শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মোতাহহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, শহীদের উপমা হচ্ছে এমন এক প্রদীপের মত যে নিজেকে পুড়িয়ে অন্যদেরকে আলো দেয় বা পথ দেখায়।
কারবালায় উৎসর্গীকৃত ও নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীদের শাহাদতের দৃশ্য দেখে শাহাদত-প্রিয় ইমাম হোসাইন (রাঃ) বলেছিলেন, "হে আমার মাবুদ! হে আমার প্রভু! তোমার আনুগত্য ও ভালবাসার পথে সত্তুর হাজার বার নিহত ও জীবন্ত হতে আগ্রহী, বিশেষ করে যদি আমার প্রাণদান তোমার ধর্মকে সহায়তা করে এবং তোমার বিধান ও শরীয়তকে জীবিত করে। "
হ্যাঁ, ইসলামের সংস্কৃতিতে এ ধরনের শাহাদত মহান আল্লাহর সান্নিধ্যের ও পরিপূর্ণতার চরম শিখর।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ও আস্থাশীল হযরত ইমাম হোসাইন (রা)'এর শাহাদতের মুহূর্ত যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই তাঁর নূরানী চেহারা আনন্দে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছিল। ইমামের তরুণ পুত্র শহীদ আলী আকবর বলেছিলেন, আমরা যেহেতু সত্যের পথে আছি, শাহাদত আমার কাছে মধুর চেয়েও বেশী প্রিয়।
আশুরা-বিপ্লব বা শাহাদতের সংস্কৃতিতে উজ্জ্বীবিত হয়েই বিংশ শতকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ও পরাশক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ইরানের মুসলিম জাতি মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র নেতৃত্বে সংঘটিত করেছে ইসলামী বিপ্লব। শাহাদত-পাগল ইরানী জাতির কাছে দুই পরাশক্তির সমর্থনপুষ্ট সাদ্দামের সমাজতান্ত্রিক বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়েছে। একই আদর্শে উজ্জ্বীবিত লেবাননের হিজবুল্লাহ ও গণপ্রতিরোধ বাহিনী দখলদার ইসরাইলের অপরাজেয় থাকার দর্প চূর্ণ করেছে।
কারবালার ময়দান ছিল ঈমান ও ধর্মীয় চেতনা রক্ষার পাশাপাশি মানবতাবোধ, মানবাধিকার এবং বিবেক ও মনুষ্যত্ব রক্ষার এক বড় পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় কুফার অধিকাংশ জনগণ ব্যর্থ হয়েছিল, ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিম উম্মাহর এক বিশাল অংশ। মুসলিম নামধারী ইয়াজিদ ও ইবনে-জিয়াদ চক্র ফোরাতের পানি থেকে ইমাম পরিবার এবং তার সঙ্গী-সাথীদের বঞ্চিত করে পাশবিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল। ইমাম হোসাইন (রা)পানির পিপাসায় কাতর মৃতপ্রায় ৬ মাসের নিষ্পাপ শিশু হযরত আলী আসগরের জন্য পানি প্রার্থনা করলে ইয়াজিদের অনুগত সেনারা এই শিশুর গলায় তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করতে বাধ্য করে। অথচ ইমাম হোসাইন (রা) তার বিরুদ্ধে লড়তে আসা শত্রু সেনারা যাতে পানির অভাবে কষ্ট না পায় সে জন্য কারবালায় আসার পর পরই তিনি পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। ইয়াজিদী শাসকগোষ্ঠী ও তার অনুসারীদের ধর্মবোধ তো দূরের কথা মানবতাবোধ বা মনুষ্যত্ববোধও ছিল না।
আজ আমরা একই ধরনের চিত্র দেখছি ফিলিস্তিনের গাজায়। প্রায় দুই বছর ধরে গাজার অধিবাসীরা ইসরাইলী অবরোধের ফলে জ্বালানী, খাদ্য ও ওষুধসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবে ধুকে ধুকে মরছে। অথচ মানবাধিকারের ও কথিত গণতন্ত্রের সমর্থক পশ্চিমা সরকারগুলো এ ব্যাপারে নীরব থেকে দখলদার ইসরাইলকে উৎসাহ যুগিয়ে আসছে। শুধু অবরোধেই ক্ষান্ত হয়নি মানবতার শত্রু ইসরাইল ও তার দোসরারা। গণতান্ত্রিকভাবে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী ইসলামপন্থী হামাস সরকারকে সমর্থনের কারণে গাজা ও পশ্চিম তীরে হামাসের সমর্থক ফিলিস্তিনীদের ওপর সন্ত্রাসী হত্যা অভিযানও চালিয়ে আসছে বর্তমান যুগের এই ইয়াজিদী গোষ্ঠী। আর এসব হামলার জবাবে অসম শক্তির অধিকারী হামাস মাঝে মধ্যে দখলদার ইহুদিবাদীদের অবৈধ বসতিগুলোর ওপর সাধারণ মর্টার ও রকেট নিক্ষেপ করায় হামাসের আত্মরক্ষার এই শক্তিটুকুকেও নির্মূল করার জন্য আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সেখানে পাইকারীভাবে শক্তিশালী ও এমনকি ইউরেনিয়ামযুক্ত বোমা বর্ষণ করে নারী ও শিশুসহ শত শত বেসামরিক ফিলিস্তিনীকে শহীদ করেছ ইসরাইলী হায়েনার দল। দুঃখজনক ব্যাপার হলো সেইযুগের ইয়াজিদের সহযোগী ইবনে জিয়াদ, শিমার ও ওমর সাদের মত কোনো কোনো আরব সরকার ইসরাইলের এ গণহত্যায় গোপনে শরীক বা সহযোগী হয়েছে।
গাজার মসজিদ, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিশুদের স্কুলগুলোও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত স্মার্ট বোমার ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু যারা আশুরার শাহাদতের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এমন জাতির জাগরণকে এটম বোমা মেরেও স্তব্ধ করতে পারবে না পশু শক্তি। আধুনিক সভ্যতার যুগেও বিবেক-বিসর্জিত যে শক্তি হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা মেরে দেশটিকে নতজানু করতে পেরেছে, সেই শক্তি আজ শাহাদতের চেতনায় উজ্জ্বীবীত ইরাকী ও আফগান জাতির কাছেও পরাজয়ের সম্মুখীন। কারবালার বীর শহীদানের মতো গাজার শহীদানরাও আজ আঁজলা ভরে প্রাণের সঞ্চার করছে মসলিম উম্মাহর শিরা-উপশিরা ও ধমনীতে। তাই ইমাম হোসাইন (রা)'র আদর্শের অনুসারীরা আজ শুধু কথায় নয় কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সবক্ষেত্রে কুফুরি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদারদের বিরুদ্ধে এ ধরনের লড়াইয়ে অংশ নিলেই বিশ্বনবী (সাঃ) ও ইমাম হোসাইন (আঃ)'র পবিত্র আত্মা প্রশান্তি পাবেন। মহান আল্লাহই পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তোমরা হীনবল হয়োনা, ভীত হয়ো না, তোমরাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে, যদি তোমরা মুমিন হও।
হ্যা, ইমাম হোসাইন (আঃ)'র রক্ত যেমন তরবারীর ওপর বিজয়ী হয়েছিল তেমনি আল্লাহর শক্তিতে পূর্ণ বিশ্বাসী গাজার বীর মুজাহিদ এবং অসহায় নারী ও শিশুদের রক্তও এ যুগের ইয়াজিদ, চেঙ্গিজ ও হালাকু খাঁর মত পশুশক্তির ওপর বিজয়ী হবে। এ বিজয় কেবলই সময়ের ব্যাপার। কারণ, গাজার তরুণ শিশুসহ সেখানকার সবার মুখে মুখে এখন এ শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে - হাসবুন আল্লাহু ওয়ানেয়ামাল ওয়াক্বীল- আমাদের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর অভিভাবকত্বই যথেষ্ট।
বিবেক মানুষের ফিতরাত বা প্রকৃতির অংশ। বিবেকের দংশনে কারবালার নরঘাতকদের কেউ কেউ পাগল হয়ে গিয়েছিল, পাগল হয়েছিল হিরোসীমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে দুই লক্ষেরও বেশী মানুষ হত্যাকারী মার্কিন বৈমানিক। ইসরাইলের সহযোগী আরব ও পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা কি তাহলে মানুষ নন? #
Subscribe to:
Posts (Atom)