Friday, January 2, 2009

গাজা ও কারবালার শাহাদতের সংস্কৃতি

বর্ষ-পরিক্রমায় আবারও ফিরে এসেছে বুকের বেদনায়-ঢাকা মহররম মাস ও রক্তের আখরে লেখা আশুরা-বিপ্লবের শিহরণ-জাগানো দিনগুলো। দিকে দিকে আবারও শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত ও ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মুক্তিকামী মানুষের নেতা চিরউন্নত-শির হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)'র চিরঅক্ষয় নাম। ইসলামের এই ত্রাণকর্তা ও মহান ইমাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের চির-উজ্জ্বল, চির-সুন্দর এবং প্রেমময় দৃষ্টান্ত। আত্মত্যাগের ইতিহাসে তিনি কালোত্তীর্ণ ও চিরসবুজ প্রতীক। মুক্তিকামী মানুষের নয়নমনি ও নিপীড়িত মানুষের ধ্যানের ছবি ইমাম হোসাইন (আঃ) ধর্ম, মানবিকতা, বিবেক, মনুষ্যত্ব, মর্যাদাবোধ এবং যুক্তি, সত্য, মহত্ত্ব ও সর্বপরি খোদা-প্রেমের সবগুলো মানদন্ডে মানবজাতি ও মানবইতিহাসের নজিরবিহীন মডেল। প্রায় ১৪০০ বছর আগে সত্যের পক্ষে মৃত্যুবরণ করে তিনি শুধু ইসলাম ধর্মেরই নয় একইসাথে মানবজাতির মর্যাদা রক্ষা করেছেন। তিনি শিখিয়ে গেছেন মুক্তির এই মহামন্ত্র যে, "যতদিন থাকবে ধরায় আত্মদান অত্যাচারীর খড়গ-কৃপানে মানবতা হারাবে না সম্মান জেগে ওঠে ইসলাম পুণরায় জগতের প্রতিটি কারবালায়।" সত্যের পক্ষে আত্মদান যে বৃথা যায় না, বরং তা যে সমাজের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা তাগুতি শক্তিকে নির্মূল করার এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা জুলুম, অত্যাচার, দুর্নীতি, অবিচার, ভীরুতা, আপোসকামীতাসহ সমস্ত পাপ-পংকিলতার মূলোৎপাটনের মহৌষধ তারই প্রমাণ আশুরার এই মহাবিপ্লব। শাহাদতে যে গোটা সমাজকে মুক্তিপাগল ও বিশুদ্ধ-আদর্শকামী করে তোলার মোক্ষমতম পন্থা মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে অক্ষয় আসনের অধিকারী ইমাম হোসাইন সহ তাঁর প্রকৃত অনুসারীরা তা যুগে যুগে প্রমাণ করেছেন। তারা দেখিয়ে গেছেন শাহাদতেই রয়েছে প্রকৃত জীবন তথা মর্যাদার জীবন, আর অন্যায়ের সাথে আপোস করে বেঁচে থাকার মধ্যে রয়েছে বঞ্চনা ও অবমাননার দুঃসহ গ্লানি। শাহাদতের চির-অম্লান আইকন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন কবির এই অমর বাণীঃ জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনই জানি শহীদী রক্ত হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানী।
ইসলামের মহান খেলাফত ও ইসলামের অস্তিত্ব যখন মুসলিম নামধারী জালেম এবং তাগুতি শক্তির হাতে পুরোপুরি বিলুপ্তির সম্মুখীন ইসলাম ও মানবতার সেই মহাদূর্দিনে নিজ আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে আশুরা বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) বলেছিলেন, " তোমরা কি দেখছো না সত্যের বা ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা হচ্ছে না এবং কেউই অন্যায়ের বিরোধিতা করছে না? এ অবস্থায় এমন লাঞ্ছনার জীবনের চেয়ে একজন বিশ্বাসী বা মুমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর সাথে মিলন তথা শাহাদতই বেশী কাম্য। " ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম প্রচারের অন্যতম প্রধান অগ্রদূত ও বিশিষ্ট ইরানী সূফী সাধক হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রঃ) হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)'র কালজয়ী বিপ্লবের প্রশংসা করে বলেছেন, হোসাইনই ধর্ম এবং ধর্মের রক্ষাকর্তা, তিনিই লা-ইল্লাল্লাহর ভিত্তি বা বুনিয়াদ রক্ষাকারী, শির দিয়েছেন, তবুও ইয়াজিদের হাতে হাত দেন নি বা ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করেন নি। শাহাদত জীবনকে দেয় অপার মহিমা। এ কারণেই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, যাঁরা আল্লাহর পথে শহীদ তাঁদের মৃত বলো না। শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মোতাহহারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, শহীদের উপমা হচ্ছে এমন এক প্রদীপের মত যে নিজেকে পুড়িয়ে অন্যদেরকে আলো দেয় বা পথ দেখায়। কারবালায় উৎসর্গীকৃত ও নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীদের শাহাদতের দৃশ্য দেখে শাহাদত-প্রিয় ইমাম হোসাইন (রাঃ) বলেছিলেন, "হে আমার মাবুদ! হে আমার প্রভু! তোমার আনুগত্য ও ভালবাসার পথে সত্তুর হাজার বার নিহত ও জীবন্ত হতে আগ্রহী, বিশেষ করে যদি আমার প্রাণদান তোমার ধর্মকে সহায়তা করে এবং তোমার বিধান ও শরীয়তকে জীবিত করে। " হ্যাঁ, ইসলামের সংস্কৃতিতে এ ধরনের শাহাদত মহান আল্লাহর সান্নিধ্যের ও পরিপূর্ণতার চরম শিখর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ও আস্থাশীল হযরত ইমাম হোসাইন (রা)'এর শাহাদতের মুহূর্ত যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই তাঁর নূরানী চেহারা আনন্দে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছিল। ইমামের তরুণ পুত্র শহীদ আলী আকবর বলেছিলেন, আমরা যেহেতু সত্যের পথে আছি, শাহাদত আমার কাছে মধুর চেয়েও বেশী প্রিয়। আশুরা-বিপ্লব বা শাহাদতের সংস্কৃতিতে উজ্জ্বীবিত হয়েই বিংশ শতকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ও পরাশক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ইরানের মুসলিম জাতি মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র নেতৃত্বে সংঘটিত করেছে ইসলামী বিপ্লব। শাহাদত-পাগল ইরানী জাতির কাছে দুই পরাশক্তির সমর্থনপুষ্ট সাদ্দামের সমাজতান্ত্রিক বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়েছে। একই আদর্শে উজ্জ্বীবিত লেবাননের হিজবুল্লাহ ও গণপ্রতিরোধ বাহিনী দখলদার ইসরাইলের অপরাজেয় থাকার দর্প চূর্ণ করেছে। কারবালার ময়দান ছিল ঈমান ও ধর্মীয় চেতনা রক্ষার পাশাপাশি মানবতাবোধ, মানবাধিকার এবং বিবেক ও মনুষ্যত্ব রক্ষার এক বড় পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় কুফার অধিকাংশ জনগণ ব্যর্থ হয়েছিল, ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিম উম্মাহর এক বিশাল অংশ। মুসলিম নামধারী ইয়াজিদ ও ইবনে-জিয়াদ চক্র ফোরাতের পানি থেকে ইমাম পরিবার এবং তার সঙ্গী-সাথীদের বঞ্চিত করে পাশবিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল। ইমাম হোসাইন (রা)পানির পিপাসায় কাতর মৃতপ্রায় ৬ মাসের নিষ্পাপ শিশু হযরত আলী আসগরের জন্য পানি প্রার্থনা করলে ইয়াজিদের অনুগত সেনারা এই শিশুর গলায় তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করতে বাধ্য করে। অথচ ইমাম হোসাইন (রা) তার বিরুদ্ধে লড়তে আসা শত্রু সেনারা যাতে পানির অভাবে কষ্ট না পায় সে জন্য কারবালায় আসার পর পরই তিনি পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। ইয়াজিদী শাসকগোষ্ঠী ও তার অনুসারীদের ধর্মবোধ তো দূরের কথা মানবতাবোধ বা মনুষ্যত্ববোধও ছিল না। আজ আমরা একই ধরনের চিত্র দেখছি ফিলিস্তিনের গাজায়। প্রায় দুই বছর ধরে গাজার অধিবাসীরা ইসরাইলী অবরোধের ফলে জ্বালানী, খাদ্য ও ওষুধসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবে ধুকে ধুকে মরছে। অথচ মানবাধিকারের ও কথিত গণতন্ত্রের সমর্থক পশ্চিমা সরকারগুলো এ ব্যাপারে নীরব থেকে দখলদার ইসরাইলকে উৎসাহ যুগিয়ে আসছে। শুধু অবরোধেই ক্ষান্ত হয়নি মানবতার শত্রু ইসরাইল ও তার দোসরারা। গণতান্ত্রিকভাবে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী ইসলামপন্থী হামাস সরকারকে সমর্থনের কারণে গাজা ও পশ্চিম তীরে হামাসের সমর্থক ফিলিস্তিনীদের ওপর সন্ত্রাসী হত্যা অভিযানও চালিয়ে আসছে বর্তমান যুগের এই ইয়াজিদী গোষ্ঠী। আর এসব হামলার জবাবে অসম শক্তির অধিকারী হামাস মাঝে মধ্যে দখলদার ইহুদিবাদীদের অবৈধ বসতিগুলোর ওপর সাধারণ মর্টার ও রকেট নিক্ষেপ করায় হামাসের আত্মরক্ষার এই শক্তিটুকুকেও নির্মূল করার জন্য আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সেখানে পাইকারীভাবে শক্তিশালী ও এমনকি ইউরেনিয়ামযুক্ত বোমা বর্ষণ করে নারী ও শিশুসহ শত শত বেসামরিক ফিলিস্তিনীকে শহীদ করেছ ইসরাইলী হায়েনার দল। দুঃখজনক ব্যাপার হলো সেইযুগের ইয়াজিদের সহযোগী ইবনে জিয়াদ, শিমার ও ওমর সাদের মত কোনো কোনো আরব সরকার ইসরাইলের এ গণহত্যায় গোপনে শরীক বা সহযোগী হয়েছে। গাজার মসজিদ, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিশুদের স্কুলগুলোও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত স্মার্ট বোমার ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু যারা আশুরার শাহাদতের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এমন জাতির জাগরণকে এটম বোমা মেরেও স্তব্ধ করতে পারবে না পশু শক্তি। আধুনিক সভ্যতার যুগেও বিবেক-বিসর্জিত যে শক্তি হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা মেরে দেশটিকে নতজানু করতে পেরেছে, সেই শক্তি আজ শাহাদতের চেতনায় উজ্জ্বীবীত ইরাকী ও আফগান জাতির কাছেও পরাজয়ের সম্মুখীন। কারবালার বীর শহীদানের মতো গাজার শহীদানরাও আজ আঁজলা ভরে প্রাণের সঞ্চার করছে মসলিম উম্মাহর শিরা-উপশিরা ও ধমনীতে। তাই ইমাম হোসাইন (রা)'র আদর্শের অনুসারীরা আজ শুধু কথায় নয় কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সবক্ষেত্রে কুফুরি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদারদের বিরুদ্ধে এ ধরনের লড়াইয়ে অংশ নিলেই বিশ্বনবী (সাঃ) ও ইমাম হোসাইন (আঃ)'র পবিত্র আত্মা প্রশান্তি পাবেন। মহান আল্লাহই পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তোমরা হীনবল হয়োনা, ভীত হয়ো না, তোমরাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে, যদি তোমরা মুমিন হও। হ্যা, ইমাম হোসাইন (আঃ)'র রক্ত যেমন তরবারীর ওপর বিজয়ী হয়েছিল তেমনি আল্লাহর শক্তিতে পূর্ণ বিশ্বাসী গাজার বীর মুজাহিদ এবং অসহায় নারী ও শিশুদের রক্তও এ যুগের ইয়াজিদ, চেঙ্গিজ ও হালাকু খাঁর মত পশুশক্তির ওপর বিজয়ী হবে। এ বিজয় কেবলই সময়ের ব্যাপার। কারণ, গাজার তরুণ শিশুসহ সেখানকার সবার মুখে মুখে এখন এ শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে - হাসবুন আল্লাহু ওয়ানেয়ামাল ওয়াক্বীল- আমাদের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর অভিভাবকত্বই যথেষ্ট। বিবেক মানুষের ফিতরাত বা প্রকৃতির অংশ। বিবেকের দংশনে কারবালার নরঘাতকদের কেউ কেউ পাগল হয়ে গিয়েছিল, পাগল হয়েছিল হিরোসীমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে দুই লক্ষেরও বেশী মানুষ হত্যাকারী মার্কিন বৈমানিক। ইসরাইলের সহযোগী আরব ও পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা কি তাহলে মানুষ নন? #

No comments: