Friday, June 1, 2007

পারমানবিক বোমা দেশে দেশে

পরমাণূ প্রযুক্তির অধিকারী দেশগুলোর মধ্যে কোনো কোনো দেশ শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে পরমাণূ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু পরমাণূ শক্তিধর অন্য দেশগুলো শিল্প বা অন্যান্য শান্তিপূর্ণ ক্ষেত্রে পরমাণূ শক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে। পরমাণূ অস্ত্রের অধিকারী দেশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগে রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, বৃটেন ও চীন। এই দেশগুলো পারমাণবিক কাবের পুরনো সদস্য। একইসাথে এ দেশগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেরও স্থায়ী সদস্য। এই দেশগুলো পরমাণূ অস্ত্র উৎপাদন ও বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তি বা এনপিটি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বৃহৎ পঞ্চশক্তি বলে পরিচিত এই দেশগুলো তাদের পরমাণূ অস্ত্র ধ্বংসের ব্যাপারে এই চুক্তির কোনো শর্তই পালন করেনি। পরমাণূ অস্ত্রের অধিকারী দ্বিতীয় শ্রেণীর দেশগুলো পরমাণূ অস্ত্র উৎপাদন ও বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তি বা এনপিটিতে স্বার করেনি। ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইহুদিবাদী ইসরাইল এই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকাই সর্বপ্রথম এই ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নির্মাণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে এ অস্ত্রের অধিকারী হলে বিশ্বের সামরিক ভারসাম্য বদলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকা জাপানের হিরোসীমা ও নাগাসাকি শহরের জনগণের ওপর পরমাণূ বোমা নিপে করায় জাপান সরকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। রাশিয়া : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সাথে শক্তির ভারসাম্য রার জন্যে পরমাণূ অস্ত্র অর্জনের জোর প্রচেষ্টা চালায় । মস্কো ১৯৪৯ সালে তার পরমাণূ অস্ত্রের পরীক্ষা সম্পন্ন করে। ফ্রান্স, বৃটেন ও চীন : রাশিয়ার পর ফ্রান্স, বৃটেন ও চীন ষাটের দশকে পরমাণূ বোমার অধিকারী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটে। আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে মূলতঃ গোটা বিশ্ব দুটি ব্লক বা বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এক্ষেত্রে এ উভয় পরাশক্তির জন্যেই পরমাণূ শক্তি পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত হয়। পরমাণূ শক্তির কারণে এ উভয় দেশ পাঁচ দশকেরও বেশী সময় ধরে পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থেকেছে। কারণ পরমাণূ শক্তিধর এ দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে তাতে কেউই বিজয়ী হতো না। কার কাছে কতটি বোমা ? আমেরিকা : সর্বসামপ্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে সাতাশ হাজার ছয়শোটি পরমাণূ অস্ত্র রয়েছে। এরমধ্যে আমেরিকার কাছে রয়েছে অন্ততঃ দশ হাজার পরমাণূ অস্ত্র। রাশিয়া : বিশ্বে আমেরিকার পরে রাশিয়ার কাছেই সবচেয়ে বেশী পরমাণূ অস্ত্র রয়েছে। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর রাশিয়ার পরমাণূ অস্ত্রের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ায় দেশটির সামরিক বাজেট ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে এবং এমনকি দেশটি তার অনেক পরমাণূ স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের খরচও যোগাতে পারছে না। ফ্রান্সঃ ফ্রান্স ১৯৬০ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ২১০ টি পরমাণূ অস্ত্র পরীক্ষা করেছে। ১৯৯২সালে এ দেশটির পরমাণূ অস্ত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১১০টিতে। ফ্রান্সের ৮৪ টি বিমান ও চারটি ডুবোজাহাজের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশ পরমাণূ অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে। বৃটেনঃ ফ্রান্সের পর বৃটেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরমাণূ শক্তি। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে দেশটি প্রায় ৮৩৪ টি পরমাণূ অস্ত্র নির্মাণ করেছে। বৃটেনেরও চারটি পরমাণবিক ডুবো জাহাজ রয়েছে। এই ডুবোজাহাজগুলোর প্রত্যেকটিই ১৬টি ট্রাইডেন্ট ক্ষেপনাস্ত্রে সজ্জিত। চীনঃ চীন পারমাণবিক কাবের পঞ্চম সদস্য। এই দেশটির কাছে ৪০০টি পরমাণূ অস্ত্র রয়েছে এবং পরমাণূ অস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্যে বিভিন্ন ধরনের উৎক্ষেপণ মঞ্চও রয়েছে। চীন তার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি করে চলেছে। ভারতঃ ভারত সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে পরমাণূ অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এরপর দেশটি ১৯৮৮ সালে আরো ৫টি পরমাণূ অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। ভারতের পরমাণূ অস্ত্রের প্রকৃত সংখ্যা কয়টি তা নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে মনে করা হয় ভারতের কাছে ৭৫ থেকে ১১০টি পরমাণূ অস্ত্র রয়েছে। পাকিস্তান: দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ৮০'র দশকে পরমাণূ তৎপরতা শুরু করে। দেশটির কাছে ৫০-৬০টি বোমা রয়েছে। উত্তর কোরিয়াঃ পূর্ব এশিয়ার অন্য একটি দেশ উত্তর কোরিয়ার কাছে নয়টি পরমাণূ অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। ইসরাইল: বর্ণবাদী ইসরাইল ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো পরমাণূ অস্ত্র নির্মাণ করে। দখলদার ইসরাইলের পরমাণূ অস্ত্রের সঠিক সংখ্যা কতো তা জানা বেশ কঠিন। তবে ইহুদিবাদী ইসরাইলের কাছে প্রায় ২০০ পরমাণূ বোমা বা অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। পরমাণু বোমা ও আমেরিকা : আমেরিকা চায় পরমাণূ অস্ত্র শুধু পারমাণবিক কাবভূক্ত দেশের মধ্যেই সীমিত থাকুক। অর্থাৎ পরমাণূ অস্ত্রের অধিকারী ৫ টি দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের কাছে পরমাণূ অস্ত্র থাকুক তা আমেরিকার কাম্য নয়। অবশ্য আমেরিকার এ নীতির ক্ষেত্রে ইসরাইলকে ব্যতিক্রম ধরা হয়েছে। আমেরিকা সেই ষাটের দশকের প্রথম থেকেই দখলদার ইসরাইলকে পরমাণূ ক্ষেত্রে সহযোগীতা করে আসছে। পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধে আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহঃ ১৯৪৫ সালে মার্কিন পরমাণূ বোমার আঘাতে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি ধ্বংস হয়ে গেলে বিশ্ববাসী পরমাণূ বোমার প্রলয়ংকরি ধ্বংসাত্মক মতা সম্পর্কে অবহিত হয়। কিন্তু পরমাণূ অস্ত্র উৎপাদন ও বিস্তার নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত চুক্তি বা এনপিটি প্রণয়ন করতে বিশ্ব সমাজ আরো দুই দশক সময় নেয়। বিশ্ব সমাজ ১৯৬৯ সালে এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি স্বারিত হবার পর আমেরিকা ও রাশিয়া তাদের পরমাণূ অস্ত্রগুলোর সংখ্যা কমানোর জন্যে আরো কয়েকটি চুক্তি স্বার করে। এ চুক্তিগুলো সল্ট-এক, সল্ট-দুই, স্টার্ট-এক ও স্টার্ট দুই নামে পরিচিত। কিন্তু পরমাণূ অস্ত্রের অধিকারী কোনো দেশই এনপিটিতে উল্লেখিত শর্ত অনুযায়ী পরমাণূ অস্ত্র কমিয়ে ফেলতে রাজী হয়নি। সল্ট-এক, সল্ট-দুই, স্টার্ট-এক ও স্টার্ট দুই প্রভৃতি চুক্তিগুলোও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনায় প্রভাবিত হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পরমাণূ অস্ত্রের বিস্তার নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ নিরসনের লক্ষ্যে পরমাণূ অস্ত্র পরীক্ষা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার চুক্তি তথা কমপ্রিহেন্সিভ টেষ্ট ব্যান ট্রিটি বা সংক্ষেপে সি টি বি টি চুক্তি স্বারিত হয়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পরমাণূ অস্ত্রের অধিকারী দেশ আমেরিকা এখনও এ চুক্তি অনুমোদন করতে রাজী হয়নি। আর এ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা বিশ্বে পরমাণূ অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে আগ্রহী বলে যে প্রচার চালিয়ে থাকে তা সত্য বা আন্তরিক নয়। আসলে মার্কিন সরকার শুধু বিশ্বব্যাপী নিজের আধিপত্য ও কতৃর্ত্ব বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর।

No comments: