Friday, June 1, 2007

ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙক্ষিপ্ত চিত্র

১৯৭৯ সালে আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট রেজা শাহ সরকারের পতনের পর থেকেই মার্কিন সরকার ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিপ্লব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা ইরান সরকারের উপর ইরাককে দিয়ে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল,তাতেও লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। ইরাক ও ইরানের মধ্যে ৮ বছর স্থায়ী ঐ যুদ্ধ থেকে ইরান প্রতিরক্ষার এক অসামান্য অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তেহরানের বিপ্লবী সরকারকে গোড়াতেই থামিয়ে দেয়ার মার্কিন পরিকল্পনা আজ ইরানকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। সামরিক ক্ষেত্রে ইরানের গত ২৭ বছরের অর্জন, দেশটির বিরুদ্ধে হুট করে কিছু করে বসার খামখেয়ালিপনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রেখেছে। ইরান বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চাশটিরও বেশি দেশে অস্ত্র রপ্তানি করে বলে সমপ্রতি সেদেশের সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে। পাঠকদের কৌতুহল নিবারনের জন্য এখানে ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরী কিছু সমরাস্ত্রের পরিচিতি তুলে ধরছি : বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগ্রামী টর্পেডো : ইরান বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগ্রামী টর্পেডো বা আন্ডার ওয়াটার মিজাইলের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। গত বছরের এপ্রিল মাসে 'সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)' সাংকেতিক নামের সামরিক মহড়ায় ইরানের নৌবাহিনী ঐ ক্ষেপনাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। ইরানের নির্মিত এই টর্পেডোর গতি সেকেন্ডে একশ মিটার-যা প্রচলিত টর্পেডোগুলোর চার গুণ। বিশ্বে এ যাবৎ নির্মিত টর্পেডোগুলোর সর্বোচ্চ গতি সেকেন্ডে ২৫মিটার। ইরানের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইব্রাহিম দেহক্বানি এই টর্পেডো সম্পর্কে বলেছেন, ইরানের বিজ্ঞানীরা অন্য কোন দেশের সহযোগীতা ছাড়াই বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন আন্ডার ওয়াটার মিজাইল তৈরী করেছে। তিনি বলেছেন, রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম এই টর্পেডোর ছোবল থেকে বিশ্বের অত্যাধুনিক সাবমেরিনও নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। ইরান অত্যাধুনিক টর্পেডো তৈরির ঘোষণা দেয়ার পর পশ্চিমা বিশ্ব বিস্মিত হয়েছে। ইরানও যে এ ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করতে পারে, তা পাশ্চাত্যের ধারনার বাইরে ছিল। ইরানের নৌ বাহিনী এই টর্পেডোর নাম দিয়েছে হুত বা তিমি। তিমির মতো ক্ষিপ্র গতি সম্পন্ন বলেই হয়তো এই নামটি নির্বাচন করা হয়েছে। পারস্য উপসাগর ও ওমান সাগরে মোতায়েন মার্কিন নৌ বহরগুলোর হুমকি মোকাবেলা করার লক্ষ্যেই ইরান অত্যাধুনিক আন্ডার ওয়াটার মিজাইল তৈরীর কাজে হাত দিয়েছিল। ফাজর-৩ ক্ষেপনাস্ত্র : রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম এপ্রিলের সামরিক মহড়া চলাকালে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ফাজর(উষা)-3 ক্ষেপনাস্ত্রেরও সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। বিশ্বের কোন রাডারই ইরানের নির্মিত অত্যাধুনিক ফাইং বোটের উপস্থিতি আঁচ করতে পারবে না এবং এটি চলন্ত অবস্থায় পানির উপরিভাগ থেকে নিমিষেই শুন্যে উঠে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। ফাজর(উষা)-৩ ক্ষেপনাস্ত্রের পাল্লা চলি্লশ কিলোমিটার । সাগরে নিজস্ব প্রযুক্তির স্মার্ট মাইন ঃ ইরানের নৌ বাহিনী সাগরে নিজস্ব প্রযুক্তির স্মার্ট মাইন বসানোর মহড়াও সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছে। বিপদের সময় মুহুর্তের মধ্যেই যাতে কৌশলগত হরমুজ প্রণালীকে শত্রুদের জন্য মৃতু্যপুরিতে পরিণত করা যায়- সে লক্ষ্যেই মাইন বসানোর ঐ মহড়া দেয়া হয়েছে। এই সরু জলপথ দিয়েই বিশ্বের 40 শতাংশ তেল, জাহাজে করে সরবরাহ করা হয়। ব্যালাস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র : শাহাব-৩ ২০০৩ সালে ইরান শাহাব বা উল্কা-3৩সাংকেতিক নামের দুই হাজার একশ কিলোমিটার পাল্লার ব্যালাস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রটির সফল পরীক্ষা চালায়। ইরানের দূর পাল্লার এই ক্ষেপনাস্ত্র অনায়াসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের অভ্যন্তরে আঘাত হানতে সক্ষম। ইরান শাহাব-৩ এর সাহায্যে ইসরাইল ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো গুড়িয়ে দিতে পারবে। এছাড়া, ওমান সাগর ও পারস্য উপসাগরে মোতায়েন মার্কিন সাবমেরিনগুলোও এই ক্ষেপনাস্ত্রের নাগালের মধ্যেই রয়েছে। দক্ষিণ ইউরোপেরও কয়েকটি দেশে আঘাত হানতে পারবে এই পেনাস্ত্র। ইরান দূর পাল্লার এই ক্ষেপনাসটি ব্যাপক সংখ্যায় তৈরী করছে বলে মনে করা হয়। কারণ শাহাব-৩ এর সফল পরীক্ষার পর ইরানের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলী শামখানি বলেছিলেন, ব্যাপক সংখ্যায় শাহাব-৩ ক্ষেপনাস্ত্র তৈরীর সকল সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা ইরানের রয়েছে। ইরান এরই মধ্যে দশ হাজার পাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র তৈরীর কাজে হাত দিয়েছে বলে সমর বিশারদদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র তৈরীতে সফল হলে আমেরিকাও ইরানের ক্ষেপনাস্ত্রের নাগালের ভেতরে চলে আসবে। অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমান 'বজ্র': ইরান সমপ্রতি অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমান তৈরি করেছে। ৬ই সেপ্টেম্বর'০৬ ইরানের বিমান বাহিনী তাদের নির্মিত প্রথম বোমারু জেট জঙ্গী বিমান প্রদর্শন করে এবং জঙ্গী বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের কথা ঘোষণা করে। ওমান সাগর ও পারস্য উপসাগরে 'জুলফিকারের আঘাত' সাংকেতিক নামের সামরিক মহড়া চলাকালে, ইরানের নির্মিত জঙ্গী বিমানের সফল উড্ডয়ন ঘটানো হয়। ইরানের নির্মিত জঙ্গী বিমানের নাম দেয়া হয়েছে- স্বায়েকে বা বজ্র। ইরানের বিমান বাহিনী বলেছে, 'বজ্র' নামের জঙ্গী বিমানটি পুরোপুরিভাবে ইরানে নির্মিত এবং একজন পাইলট চালিত এই জঙ্গী বিমান আমেরিকার এফ-এইটটিন জঙ্গী বিমানের চেয়েও শক্তিশালী। উন্নতমানের রাডার সজ্জিত ইরানের এ জঙ্গী বিমান কয়েক ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র, রকেট ও বোমা বহন এবং নিক্ষেপ করতে সক্ষম। সাবমেরিন তৈরী : ইরানের বিজ্ঞানীরা প্রথম বারের মতো সাবমেরিন তৈরী করেছে। ইরানের তৈরী তিমি শ্রেনীর সাবমেরিন পারস্য উপসাগর ও ওমান সাগরের তুলনামূলক কম গভীর ও লোনা পানিতে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে । সাবমেরিনটি তৈরীতে বিদেশী কোন বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেয়া হয় নি বলে বার্তা সংস্থা ফার্সের খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। সাবমেরিনটি ইরানি বিজ্ঞানীদের 10 বছরের নিরলস গবেষণার ফসল বলে ইরানের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন দুই হাজার পাউন্ড-গাইডেড বোমা তৈরি : জঙ্গী বিমান নির্মাণে সফলতার কথা ঘোষণার দিনই ইরানের সশস্ত্র বাহিনী দুই হাজার পাউন্ড-গাইডেড বোমা তৈরিরও ঘোষণা দেয়। বিশ্বের হাতে- গোনা কয়েকটি দেশের কাছে এ ধরনের স্মার্ট ও গাইডেড বোমা রয়েছে। এছাড়া 'জুলফিকারের আঘাত' মহড়ায় ইরানের সেনা,নৌ ও বিমান বাহিনী আলাদা আলাদা ভাবে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরী কয়েকশ কিলোমিটার পাল্লার বিভিন্ন মডেলের ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা : ইরানের নিয়মিত সৈন্য সংখ্যা পাঁচ লক্ষেরও বেশী। আধা সামরিক বাহিনীতেও কয়েক ল প্রশিক্ষিত সদস্য রয়েছে। এছাড়া ইরানের 15 বছরের বেশী বয়সী সকল পুরুষের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া বাধ্যতামূলক। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের কথা : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী-ই হচ্ছেন, ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি সমপ্রতি সেদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আরও বেশী শক্তি অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীকে এত বেশী শক্তি অর্জন করতে হবে যাতে বলদর্পী দেশগুলো ইরানের সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানোরও সাহস না পায়। আঘাত এলে পালটা আঘাত : ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পূর্বে ইরানের সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল ছিল। ইরানের সেই পরনির্ভরশীল অবস্থা থেকে উত্তরণের পেছনে একটি বড় কারণ হলো-মার্কিন বৈরিতা। আমেরিকার শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র আজ ইরানের জন্য শাপে বর হয়েছে। ইরান,আমেরিকার হুমকি মোকাবেলায় নিজেকে শক্তিশালী করতে বাধ্য হয়েছে। ইরান কখনো অন্য রাষ্ট্রের উপর হামলার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু নিজ দেশ আত্রান্ত হলে ইরানের সশস্ত্রবাহিনী ও জনগণ যে কাউকেই ছেড়ে দেবে না একথা দিবালোকের মতো স্বচ্ছ।

No comments: