Saturday, July 19, 2008

ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে মহিলাদের হিজাব রক্ষার দাবী

তুরস্কের ইসলাম বিদ্বেষী ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী সেদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়েদের হিজাব বা ইসলামী শালীন পোশাক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার হঠকারি দাবী এখনও অব্যাহত রেখেছে। ক্ষমতাধর এই ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী নিজেকে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার উত্তরসূরী বলে মনে করে। তুরস্কের ধর্ম নিরপেক্ষ মহল জেনারেল কেনান এভরানের নেতৃত্বে ১৯৮২ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে । ক্ষমতা দখলের পর তারা সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের হিজাব বা পর্দার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তুরস্কে মহিলাদের মধ্যে হিজাব বৃদ্ধি পাওয়ায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মধ্যে হিজাব ছড়িয়ে পড়ায় ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা এই পদক্ষেপ নেয়। এ পদক্ষেপের ফলে হাজার হাজার তুর্কী মহিলা ও মেয়েরা শিক্ষার এবং চাকরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তুরস্কের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ জনগণ মুসলমান। বিগত ৮০ বছর ধরে তুরস্কের ইসলাম বিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষ মহল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে এবং ধর্মীয় তৎপরতার ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বসাম্প্রতিক জনমত জরীপে দেখা গেছে, শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী তুর্কী মহিলা হিজাবকে সমর্থন করছে এবং শতকরা ৮৫ ভাগেরও বেশী তুর্কী মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সংসদীয় আইন বাতিল করার বিরোধী। তুরস্কের জনগণ তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য এ পর্যন্ত অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, তারা মহিলাদের হিজাবের সমর্থক জাস্টিস ও ডেভলপমেন্ট পার্টিকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদসহ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী এই দলটি এখন ইসলাম বিদ্বেষী সংখ্যালঘিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ মহলের ক্ষমতার খুটি তথা সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার সম্মুখীন । স্যেকুলার এই গোষ্ঠী বলছে, হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে ক্ষমতাসীন দল কামাল আতাতুর্কের প্রবর্তিত স্যেকুলার মূল্যবোধের বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে। তুরস্কের মুসলিম মহিলারা হিজাব বা পর্দাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য অনেক কস্ট সহ্য করেছে। যেমন, নূরায়ী জানান বাজিরগান নামের এক তুর্কী মহিলাকে হিজাব বা পর্দা মেনে চলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হয়ে দশ বছর ধরে কারাগারে থাকতে হয়েছে। এরপর তিনি বাধ্য হয়ে তুরস্ক ত্যাগ করেন এবং এমনকি তার এক সন্তানকেও হারিয়েছেন। কিছু দিন আগে বেগাম নূরায়ী একজন সমমনা ব্যক্তির সাথে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)কে শ্রদ্ধা করেন কিনা – এ প্রশ্ন করা হলে তিনি ইতিবাচক জবাব দেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ক্বতেহ আলতায়লি এরপর তাকে প্রশ্ন করেন, আতাতুর্ককেও কি ভালবাসেন? উত্তরে বেগাম নূরায়ী বলেন, আমার ওপর যদি কোনো অত্যাচার করা না হয়, তাহলে আমি বলবো , আতাতুর্ককে পছন্দ করি না। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্য তুর্কী মহিলারাও বেগাম নূরায়ীর মতকে সমর্থন জানায়। কিন্তু তুরস্কের ইসলাম বিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষ মহল এ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে। বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান দৈনিক তুর্কী টাইমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র প্রতি তার শ্রদ্ধার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে বলেন, আমার মতে মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) একজন বিজ্ঞ ও জ্ঞানী নেতা এবং একইসাথে তিনি আমাদের বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতীম প্রতিবেশী দেশের নেতা। ইমাম খোমেনী (রঃ) একজন মুমিন মুসলমান এবং তিনি এমন এক আন্দোলনের নেতা ছিলেন যিনি একনায়ক বা স্বৈরাচারি শাহের কাছ থেকে জাতির জন্য গৌরবময় স্বাধীনতা বা মুক্তি এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার আরেকটি কারণ হলো, তিনি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি খুবই সাধারণ মানুষের মতো সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। ইমাম খোমেনী (রঃ) ইরানকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এবং তিনি ইহুদিবাদী ইসরাইলের শত্রু ছিলেন। কিন্তু তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এ অঞ্চল দখলদার ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের বন্ধু এবং তুরস্ক তাদের পরোক্ষ উপনিবেশ মাত্র। তুরস্কে দেশটির ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের সমালোচনা করা বড় রকমের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ জন্য সমালোচককে প্রচারণাগত হামলার শিকার হওয়া ছাড়াও হুমকী এবং গ্রেফতারের শিকার হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামপন্থী, সাহসী ও বীরাঙ্গনা তুর্কী নারী বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান তুরস্কের ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে পছন্দ না করার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, আতাতুর্কের জীবন যাপন পদ্ধতি ও বিশ্বাসের সাথে আমার জীবন যাপন পদ্ধতি ও বিশ্বাসের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। এ কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব আমার নেই। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আতাতুর্ক ও তুরস্ককে অভিন্ন মনে করেন। তাই আপনার চিন্তাধারা যদি আতাতুর্কের চিন্তাধারার বিরোধী হয় তাহলে তারা আপনাকে তুরস্কের শত্রু বলে তুলে ধরবে। এটাই চরম কামালবাদী বা গোঁড়া আতাতুর্কপন্থীদের যুক্তি। অথচ আতাতুর্কের বিরোধীতা করা বা তার সমর্থন করা আমার স্বাভাবিক অধিকার। তুরস্কের জন্য ইসলামবিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের এ ধরনের আচরণের অর্থ হলো, নীরব থাকো এবং হিজাব ও আতাতুর্কের ব্যাপারে মাথা ঘামিও না। কাউকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে না, বরং কেবল আনুগত্য করে যাও, আমরা যেমনটি চাই তোমার অনুভুতি হতে হবে ঠিক সেরকম। ইসলামপন্থী, সাহসী ও বীরাঙ্গনা তুর্কী নারী বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান আরও বলেছেন, তুরস্কের অনেকেই আতাতুর্কের চিন্তাধারা পছন্দ করেন না, কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস রাখে না। বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান ১৯৯৮ সাল থেকে নিজ ধর্ম ও পর্দা রক্ষা করার জন্য সংগ্রামের কারণেই এ রকম সাহসী হতে পেরেছেন। সে বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে হিজাব পরার কারণে তুর্কী পুলিশ তাকে পরীক্ষার হলে মারধোর করে এবং কারাগারে নিয়ে যায়। তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হিজাবধারী ছাত্রীদের সাথে আলোচনা ও তাদের সাথে যোগাযোগের প্রভাবে বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই পর্দা বা হিজাব বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান আবারও চরম তিক্ত পরিস্থিতির শিকার হন যখন তাকে দ্বিতীয়বারের মতো কারাগারে নেয়া হয়। তীব্র মানসিক নির্যাতন ও দূর্বলতার কারণে তিনি তার যমজ সন্তানের একজনকে হারান। এর পরের বছর নিজের ও পরিবারের ওপর উপর্যপরি হুমকীর প্রেক্ষাপটে বাজিরগান কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে পড়াশুনা অব্যাহত রাখার পর তিনি ২০০৬ সালে আবার তুরস্কে ফিরে আসেন। কারণ তিনি তার মাতৃভূমি তুরস্ককে ভালবাসেন। বেগাম নূরায়ী জানান, বাজিরগানের মতো নারীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ধর্মহীনতাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ইসলামবিদ্বেষী ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি তাঁদের গভীর মমত্ববোধ অটুট ও অম্লান থেকে যায়। তুরস্কের দৈনিক জামানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হিজাব পরিহার করা তার কাছে নিজের মাথা কেটে ফেলার সমতুল্য। এ কারণে ব্যাপক চাপ সত্ত্বেও তিনি তার হিজাব বজায় রেখেছেন। এমনকি তার সাহসী বক্তব্যগুলো পরিহার করে নেয়ার জন্য তাকে বিপুল অংকের অর্থ দেয়ার প্রলোভনও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে তিনি ইসলামী অবস্থানে অনড়ই রয়ে গেছেন। বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান সঠিক যুক্তি ও পথে উপনীত হবার জন্য ইতিহাসে ফসিল হয়ে পড়া ব্যক্তিদের অনুসরণ না করে পবিত্র কোরআনের অনুসারী হবার আহ্বান জানান। মহান আল্লাহ পোশাকের মাধ্যমে বর্তমান যুগের নারীদের পরীক্ষা করছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। হিজাব করার কারণে তুরস্কের যেসব মহিলা শিক্ষা ও চাকরীর মতো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বাজিরগান বলেছেন, হিজাব সমস্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, অফিস আদালতের কর্মকর্তা এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বেশী মূল্যবান। তুরস্কে হিজাবের পক্ষে দেশটির অধিকাংশ জনগণের সমর্থনের কারণে সেখানে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা খুব বেশী দিন বজায় রাখা সম্ভব হবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

3 comments:

নিঝুম said...

আস-সালামু আলাইকুম , আশরাফ ভাই :) কেমন আছেন । আপনি দেখি ব্লগস্পটে অনেক আগে থেকে আছেন :)

আশরাফ রহমান said...

অনেক আগে থেকে থাকলেও লেখা হতো না নিয়মিত। এখন বিনির্মাণের কারণে চেষ্টা করবো নিয়মিত লিখতে। সব কৃতিত্ব আপনাদের ।

যাযাবর said...

হিজাব নিয়ে একটা লিখা মাথায় ঘুরছে। আপনার এই পোষ্টটা অনেক কাজ দেবে ;)