Wednesday, July 30, 2008

হিজবুল্লাহর বিজয়ের নেপথ্যে-২

গত ১৬ জুলাই ছিল লেবাননের জনগণ ও সেদেশের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। সেদিন ইসরাইল লেবাননী শহীদ ও বন্দীদেরকে ফেরত দিয়েছিল। পক্ষান্তরে লেবানন ইসরাইলের ২ মৃত সেনার লাশ ইসরাইলকে ফেরত দিয়েছে। বন্দী বিনিময়ের এই ঘটনাকে লেবাননের হিযবুল্লাহর ঐতিহাসিক বিজয় বলে মন্তব্য করেছে স্বয়ং অধিকৃত ফিলিস্তিনের দৈনিক ইয়াদিউত অহরুনুত।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধের সাম্প্রতিক বিজয়ের বিভিন্ন দিক রয়েছে।ইসরাইল সবসময়ই নিজেদের গোয়েন্দা বিভাগের পটুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কথা বলে এবং ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার ক্ষেত্রে তাদেরকে কাজে লাগায়। কিন্তু বন্দী বিনিময় এবং লেবাননী শহীদদের লাশ ফেরত দেওয়ার ঘটনায় ইসরাইলী এই গোয়েন্দা বিভাগ মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা লেবাননের হিযবুল্লাহর কাছে ইসরাইলীদের যে দুই সেনা ছিল,তারা যে যুদ্ধ চলাকালে আহত হবার পর মারা গিয়েছিল সেই তথ্য তাদের জানা ছিল না। তারা ভেবেছিল তাদের ঐ ২ সেনা জীবিত আছে।
অপরদিকে ইসরাইল বাধ্য হয়েছে তাদের ২ সেনাকে ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে ৫ জন বন্দী এবং লেবাননী-অলেবাননী ২০০টি লাশ হিযবুল্লাহর হাতে বুঝিয়ে দিতে। এ কারণে তেলাবিবের অনেক কর্মকর্তা বন্দী বিনিময়ের দিনটিকে ইসরাইলের ইতিহাসে একটি কালো দিবস বলে উল্লেখ করেছে। ইসরাইলের যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন-'বন্দী বিনিময় ইসরাইলের দুর্বলতাকে সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।' তিনি তাই ইসরাইলী গণমাধ্যমগুলোকে বলেছেন বন্দী বিনিময়ের খবরটিকে যেন ফলাও করে না ছাপে। এ সম্পর্কে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টও লিখেছে ইসরাইলের এই পরাজয়ের ঘটনা বিশ্বব্যাপী এবং ইসরাইলের অভ্যন্তরেও তাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে। বিশ্বের আরো বহু দৈনিকও ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের হিযবুল্লাহর ঐতিহাসিক বিজয়কে ফলাও করে তুলে ধরেছে। কোনো কোনো পত্রিকা এটাকে লেবানননের জাতীয় বিজয় বলেও মন্তব্য করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান-কি মুন এবং বিশ্বের বহু দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের এই বিজয়ে সেদেশের জনগণ ও প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দিত করেছে। এই বিজয়ের ফলে আরো যে বিশাল সাফল্য অর্জিত হয়েছে তাহলো,লেবাননের অভ্যন্তরে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছে।হিযবুল্লাহর উপমহাসচিব শায়েখ নাঈম কাসেম দৈনিক আল-আরাবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন-'বন্দী বিনিময়ের ঘটনা একদিকে যেমন লেবাননের জনগণের মাঝে ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে,তেমনি এর ফলে বন্দীদেরকে মুক্ত করার ব্যাপারে লেবাননী জনগণ ও সরকার যে আন্তরিক তা-ও প্রমাণিত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাটি লেবাননের অভ্যন্তরে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।'
বন্দী বিনিময়ের ফলে আরো যে বিষয়টি হিযবুল্লাহর জন্যে ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তাহলো,এর ফলে প্রমাণিত হলো যে হিযবুল্লাহ তাদের সেনাদের ব্যাপারে এমনকি শহীদদের লাশের ব্যাপারেও ভীষণ আন্তরিক ও দায়িত্বশীল।তারা যে মানবিক বিষয়গুলোর কথা ভুলে যায় না-এরফলে তাও প্রমাণিত হলো। শহীদদের লাশ ফিরে পেয়ে শহীদ পরিবারের লোকজন ভীষণ খুশি হয়েছে। তারচেয়েও বেশি খুশি হয়েছে সেইসব পরিবার যারা বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করার পর বন্দীদেরকে তাদের মাঝে জীবিতাবস্থায় পুনরায় ফিরে পেয়েছে। যারা শহীদ হয়েছে কিংবা বন্দী ছিল,তাদের মাঝে হিযবুল্লাহর বাইরেও অন্যান্য দলের সদস্য ছিল।
এ থেকে বোঝা যায় যে হিযবুল্লাহ কেবল স্বার্থপরের মতো নিজেদের শহীদদের ব্যাপারেই তৎপরতা চালায় নি বরং তারা দল-মত নির্বিশেষে পরিপূর্ণ ইসলামী মানবিক আচরণ করে সকল বন্দীর জন্যেই সমানভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। সামির কান্তারের মুক্তিই তার প্রমাণ। কেননা সামির কান্তার ৩০ বছর আগে অর্থাৎ হিযবুল্লাহ নামক সংগঠনটি গঠিত হবারও আগে ইসরাইলীদের হাতে বন্দী হয়েছিল। তাকে মুক্ত করার জন্যে হিযবুল্লাহ যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে,সেই প্রচেষ্টার ফলে সামির কান্তার এতো বেশি প্রভাবিত হয়েছে যে,সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে তিনি তাঁর নেতা এবং শিক্ষক বলে মন্তব্য করতেও কুণ্ঠিত হন নি। তিনি বলেছেন-তাঁর ভাষায়-'গতকাল পর্যন্ত শত্রুদের হাতে বন্দী ছিলাম,কিন্তু আজ থেকে আরো বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো।'
মজার ব্যাপার হলো,হিযবুল্লাহ অন্যান্য দেশের বন্দীদের মুক্তির জন্যেও বিশেষ করে ফিলিস্তিনী বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে হিযবুল্লাহ নেতা জনাব হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, 'বন্দী বিনিময়ের ক্ষেত্রে ইসরাইলীদের হাতে বন্দী ফিলিস্তিনীদের মুক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্যেও আমরা জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। জাতিসংঘকে লেখা আমাদের চিঠিপত্রগুলোতে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিধৃত আছে।' লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিযবুল্লাহ,আরব লীগকেও অনুরোধ করেছে,তারা যেন ইসরাইলীদের কারাগারে বন্দী আরব ও ফিলিস্তিনীদের মুক্তি দেওয়ার জন্যে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানায়।
ইসরাইলী কারাগার থেকে মুক্ত বন্দীদের অভ্যর্থনা জানানোর অনুষ্ঠানে হিযবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন-'সকল প্রতিরোধ আন্দোলন এবং এ অঞ্চলকে জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্ত করার জন্যে যারাই চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,তাদের পরিচয়, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আসলে এক এবং অভিন্ন,তাহলো-দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা'।লেবাননের জনগণ অত্যন্ত সচেতনতা এবং বিচক্ষণতার সাথে এই প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। এই সংগ্রামের মাধ্যমেই হিযবুল্লাহ ইসরাইলকে পতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে অত্যাচারীদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা এবং নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন ইরাক কিংবা ফিলিস্তিনের মতো দখলদারদের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশগুলোর জন্যে সফলতার এক অনন্য আদর্শ ও নিদর্শন। #

No comments: