Sunday, September 5, 2010

বাংলা কবিতা ও গানে ঈদ উৎসব

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ। প্রতি বছর ঈদকে সামনে রেখে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দেখা যায় নানা আয়োজন। প্রবন্ধ, গান, ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান কোন কিছুই বাদ যায় না। ঈদকে কেন্দ্র করে কবি- সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, অভিনেতাদের ব্যস্ত সময় কাটে। সত্যি বলতে কী, এমন কোন মুসলিম কবি-সাহিত্যিক কিংবা লেখককে হয়তো পাওয়া যাবে না যিনি ঈদ নিয়ে কোন লেখা লিখেননি। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষী কবি-সাহিত্যিকরাও পিছিয়ে নেই। যতটুকু জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতাটিই সম্ভবত বাংলাভাষায় রচিত প্রথম ঈদ-বিষয়ক কবিতা। ১৯০৩ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নবনূর পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় কবিতাটি ছাপা হয়। তিনি লিখেছেন-
“ ধর্ম ও কর্মরে জীবনের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করি আজ জীবনের আবহে হও অগ্রসর, নাহি তাতে কোন লাজ। যে চেতনা থাকে একদিন জাগি, দীর্ঘ নিদ্রা তার পরে, সে তো আনে শুধু ঘন অবসাদ জীবনে ঢালে অনন্ত বিষাদ দেও তারে দূর করে। ”
মানবজাতির তথা মুসলমানদের মহামিলনের উৎসব ঈদকে নিয়ে কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি এ রকম-
“ এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ, বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান। এ ত নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা। এ শুধু জাতীয় পুণ্যমিলনের এক মহামেলা। ”
কবি কায়কোবাদ ঈদকে পুণ্যমিলনের মহামেলা হিসেবে অভিহিত করলেও ইসলামের নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ না করার কারণে ঈদের দিনেও গরিব-দুঃখী ও অসহায়দের কষ্টের যেন শেষ থাকে না। এ দিকটি ফুটে ওঠেছে শাহাদাত হোসেনের ‘বাংলার ঈদ’ কবিতায়। কবি লিখেছেন,
“ বাংলার মুসলমান শুধু চেয়ে রয়- মৌন ম্লান ক্লিষ্ট মুখ নির্বাক নিশ্চল। ফিত্রার খুশী কোথা তার? কি দান সে দিবে ক্ষুধিতেরে? নিজেই কাঙাল রিক্ত- ভিক্ষা মাগি ফিরে দ্বারে দ্বারে।”
এ কবিতায় কবি ফিতরা আদায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ঠিকমত ফিতরা ও যাকাত দেয়া গেলে অসহায়, দরিদ্ররাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। সমাজে নেমে আসবে শান্তি-সুখের ফল্গুধারা। এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেই সম্ভবত কবি গোলাম মোস্তফা ঈদকে মানবতার বিরাট প্লাটফর্ম হিসেবে কল্পনা করেছেন। ঈদ উৎসব কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“ কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী, বক্ষে ভরা তার শান্তি, চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতি ভার, বিশ্ব-বিমোহন কান্তি প্রীতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগ-বেদনার শ্রান্তি।”
ঈদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা ও গান লিখেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখা -
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ।’
-এ গানটি ছাড়া ঈদের আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। এছাড়া, ‘ঈদ মোবারক’ ও ‘কৃষকের ঈদ’ ও ‘ঈদের চাঁদ’ কবি নজরুলের বহুল আলোচিত কবিতা। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় কবি লিখেছেন,
“শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো, কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো, বরষের পরে আনিলে ঈদ! ”
এ কবিতায় নজরুল দেখেছেন অসংখ্য মরুভূমি,বালুচর আর অনাবিল আঁখিজল পেরিয়ে এসেছে ঈদ। তিনি বলতে চেয়েছেন,মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সুখ-দুঃখের সমভাগী হয়ে অধিকার ভোগ আর দায়িত্ব পালনের মধ্যে যে প্রকৃত আনন্দ,সে শিক্ষা যেন রয়েছে ঈদের মাহাত্ম্যে। ঈদের মহান শিক্ষাই হচ্ছে সব ভেদাভেদ-হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঈদের জামায়াতে দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা । কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ঈদ সচরাচর দেখা যায় না। এ দিনও দেখা যায় গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা শীর্ণ গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায় জমিতে লাঙল দিতে। এদিকে ইঙ্গিত করে তিনি রচনা করেছেন তার কৃষকের ঈদ কবিতাটি। কবির ভাষায়-
“জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিদ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ? একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পুঁজরের হাড়?”
কবি নজরুলের কবিতা ও গানে ঈদের তাৎপর্য্য, এ দিনের করণীয় ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ পুরো দুনিয়াকে ঈদগাহ্‌র সাথে তুলনা করেছেন । ‘ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
আজকে এল খুশীর দিন দেখ না চেয়ে খুশীর চিন দেখ না চেয়ে আজ রঙিন খুশীর ঝলক ঈদগাহে। ................................ জামাত ছেড়ে থাকবে যে ঘরের কোণে রইবে সে রইবে হয়ে একপেশে একলা থাকায় দুঃখ তাই। সবাই মিলে একদলে এক আশাতে যাই চলে এক আশাতে যাই বলে ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই।
শাওয়ালের রূপোলী চাঁদ পশ্চিমাকাশে মুচকি হেঁসে জানিয়ে দেয় যে, ঈদ এসেছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এ দিন নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন-
“চাঁদ উঠিয়াছে, ঈদের চাঁদ কি উঠেছে? শুধায় সবে। লাখো জনতার আঁখি থির আজি সুদূর সুনীল নভে। এই ওঠে,ওই উদিল গগনে সুন্দর শিশু চাঁদ— আমিন। আমিন। রাব্বুল আলামিন করে সবে মোনাজাত।”
আগেই বলেছি, ঈদের নতুন চাঁদ সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। এদিন গরীব-দুঃখী ও অসহায়দের মনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে কবি তালিম হোসেনের ‘ঈদের ফরিয়াদ’ কবিতায়। কবির ভাষায়-
‘ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খোশরোজে দাওয়াত কবুল কর মানুষের বেদনার মহাভোজে। কহিব কি আর, চির-মানুষের ওগো বেদনার সাথী, ঈদের এ দিন শেষ হয়ে আসে, সমুখে ঘনায় রাতি।’
কবি সিকান্দার আবু জাফর প্রায় একই বিষয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। ঈদ উপলক্ষে দোয়া চেয়ে পিতার কাছে লেখা ‘ঈদের চিঠি’-তে তিনি লিখেছেন-
“ঈদের সালাম নিও,দোয়া করো আগামী বছর কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা। অন্ততঃ ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি, একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি তোমাকে পাঠাতে যেন পারি; আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা।”
অন্যদিকে সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চাঁদের হাসিতে দেখতে পেয়েছেন নতুন দিনের বারতা। লিখেছেন-
“এসেছে নূতন দিন আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ। জরির জোব্বা, শেরোয়ানী আর আমামার সজ্জায় আতরের পানি, মেশেকর রেণু খোশবু বিলায়ে যায়— বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে, রাত্রি হয়েছে ভোর।” (এসেছে নূতন দিন)
সমাজে ঈদের খুশীর প্রভাব সম্পর্কে কবি আ.ন.ম বজলুর রশিদ তার 'ঈদ আসে' কবিতায় লিখেছেন-
ঈদ আসে হাসি-খুশী তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে অনেক আনন্দ নিয়ে কিছুক্ষণ ভুলে যাই দুঃখ জ্বালা যত আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ হয়ে থাকা অবিরত আল্লাহর প্রশংসায় গান, তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে।
কবি তফাজ্জল হোসেন খান ঈদ নিয়ে চমৎকার একটি গান লিখেছেন । প্রতি বছর ঈদ এলেই শিশুরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে এ গানটি।
“আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে দুলছে খুশীর নদী প্লাবনে ঘরে ঘরে জনে জনে আজি মুখর হব মোরা গানে গানে ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক আজ বল ঈদ মোবারক আজ।”
অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক ঈদের দিনকে খুশীর দিন হিসেবে চিত্রিত করলেও কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার গানে লিখেছেন,
“ঈদের খুশী অপূর্ণ রয়ে যাবে ততদিন খোদার হুকুমাত হবে না কায়েম কায়েম হবে না যতদিন।”
কবির এ গানের কথাগুলো যৌক্তিক। কারণ দুনিয়ায় খোদার হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। আর এ বৈষম্য দূর হলেই ঈদ হবে সত্যিকার আনন্দের দিন; তা সবার হৃদয়ে বুলিয়ে দেবে প্রেম প্রীতি আর শান্তির পরশ। এছাড়া ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সারাবছর নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারলেই ঈদ উৎসব সার্থক হবে। ঈদের দিন যেভাবে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে যায়,সারাবছর ধরে সেই বিভেদের দেয়ালকে তুলে ফেলতে হবে। কবি গোলাম মোস্তফার কথায়-
“আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে, আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে, এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য নিখিল-মানবের মিলন জন্য, শুভ যা জেগে থাক,অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।”

Wednesday, March 10, 2010

দুবাইয়ে হামাস কমাণ্ডার হত্যা : ইহুদিবাদী ইসরাইলের আরেকটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস

‘টার্গেট করো এবং মেরে ফেলো’ এটা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত ইহুদীবাদী ইসরাইলের গোয়েন্দা নীতি। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সম্ভবত এ কারণেই একবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন,‘ইসরাইলের প্রধান ভ্রান্তি হলো তার কোন বিদেশ নীতি নেই, আছে কেবল প্রতিরক্ষা নীতি।’ ইসরাইলের প্রতিরক্ষা নীতি মানেই শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দমন করা ৷ প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, লাশ গুম করা, অপহরণসহ এমন কোন মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড নেই যা প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য তারা প্রয়োগ করে না। এ সব কাজের জন্য তেলআবিব সরকার মোসাদ, সিনবেথ ও আমানের মত কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনী গড়ে তুলেছে। মোসাদ-এর কাজ হলো বিদেশে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো। গোয়েন্দা তৎপরতার আড়ালে এ সংস্থাটি হামাস, হিজবুল্লাহর মত ইসরাইল বিরোধী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দকে হত্যা ও অপহরণের মত জঘন্য কাজ করে থাকে। ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কিছু দৃষ্টান্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড জবরদখল করার পর থেকেই ইসরাইল নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দেশে-বিদেশে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী নাগরিককে হত্যার পাশাপাশি তারা ফিলিস্তিনী নেতৃবৃন্দকেও হত্যা করতে থাকে। ১৯৯৫ সালে ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের নেতা ফাতহে সাকাকীকে হত্যা করে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা শিনবেথ৷ ২০০১ সালের ৩০ আগস্ট ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে পশ্চিমতীরে নিজ অফিসে হত্যা করা হয় পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন-এর নেতা আবু আলী মুস্তাফা জাবরীকে ৷ ২০০৪ সালের ২২ মার্চ হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিনকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের মাত্র ২৫ দিন পর অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল ইসরাইলী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হন হামাসের প্রভাবশালী নেতা আব্দুল আজিজ রানতিসি। ১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হামাস নেতা খালেদ মাশআলকে আম্মানে বিষ-প্রয়োগে হত্যার তথ্য জনসম্মুখে ফাঁস হয়ে পড়ায় তাকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। ফিলিস্তিনে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়াকেও ইসরাইল হত্যার হুমকি দিয়েছে। হামাসের পাশাপাশি ইসরাইলী বাহিনী লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ নেতৃবৃন্দকেও হত্যার মিশন শুরু করে। ১৯৯২ সালে বিমান থেকে হামলা চালিয়ে হত্যা করে হিজবুল্লাহ নেতা শেখ আব্বাস আল-মুশাওয়ীকে ৷ হিজবুল্লাহর অন্য দুই নেতা শেখ আবদুল করিম ওবেইদ ও মুস্তাফা আল দিরানীকে যথাক্রমে ১৯৮৯ ও ১৯৯৪ সালে অপহরণ করা হয় ৷ ২০০৮ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইহুদীবাদী গুপ্ত ঘাতকরা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে লেবাননের হিযবুল্লাহর সামরিক শাখার প্রধান ইমাদ মুগনিয়াকে তার গাড়িতে বোমা পেতে রেখে হত্যা করে। এভাবে ইহুদীবাদী ইসরাইল সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ সন্ত্রাসের সর্ব-সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে, দুবাইয়ে ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের শীর্ষস্থানীয় কমাণ্ডার মাহমুদ আল মাবহুর হত্যাকাণ্ড। সেদিন যা ঘটেছিল গত ২০শে জানুয়ারি দুবাইয়ের একটি বিলাশবহুল হোটেলে হামাসের শীর্ষ সামরিক কমাণ্ডার মাহমুদ আল মাবহুকে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ঘাতকরা হত্যা করে। টাইমস অব লন্ডন জানিয়েছে, ইসরাইলের ঘাতক দল হামাস নেতার দেহে ইনজেকশন দেয়ার কারণে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাসরোধ করে এবং ইলেকট্রিক শক দিয়ে হত্যা করা হয় হামাসের এরপর ঘাতক দল হামাস নেতার ব্রিফকেসে যে সব কাগজপত্র ছিলো তার ছবি তুলে এবং হোটেল কক্ষের বাইরে 'বিরক্ত করো না' এই নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়ে চুপিসারে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঘাতক দল তার মৃতদেহ আবিষ্কার হওয়ার আগেই দুবাই ত্যাগ করতে সক্ষম হয় বলে অন্য এক খবরে বলা হয়েছে। মাবহু ছিলেন হামাসের সামরিক শাখা ইযাদ্দিন কাসসাম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা। ৫০ বছর বয়সী মাবহু ১৯৮৯ সাল থেকেই সিরিয়ায় বসবাস করছিলেন। কিন্তু দুবাইয়ে আসার একদিন পরেই তাকে হত্যা করা হয়। ঘাতকদের পরিচয় হামাস নেতাকে হত্যার পর দুবাই পুলিশ সন্দেহভাজন ১১ জনের ছবি ও ফুটেজ প্রকাশ করে জানায়, ঘাতক ইসরাইলী গুপ্তচরদের মধ্যে ছয়জন ব্রিটিশ, তিনজন আইরিশ ও একজন করে জার্মান এবং ফরাসি পাসপোর্ট ব্যবহার করেছে। দুবাই পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর ১১ জন সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে বলেছে, তাদের সবাই ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের পাসপোর্টে দুবাই এসেছিলো। দুবাই পুলিশ প্রধান দাহি খালফান তামিম বলেছেন, যে ১১ ব্যক্তিকে তারা হত্যাকাণ্ডের দায়ে সন্দেহ করছেন তাদের পাসপোর্টের নামের সাথে তারা বিমানের টিকেট কেনার সময় যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেছেন, তার হুবহু মিল রয়েছে। এরপর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুবাই পুলিশ হামাস নেতা হত্যাকাণ্ডে জড়িত নতুন ১৫ জন সন্দেহভাজনের নামের তালিকা ছবিসহ প্রকাশ করে। ঐ ১৫ জনের মধ্যে ৫ জন ব্রিটেনের,৩ জন করে ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিল। এ নিয়ে ঘাতক দলের মোট ২৬ জনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়। ই.ইউ. ও চার ইউরোপীয় দেশের প্রতিক্রিয়া হামাসের শীর্ষ নেতা মাহমুদ আল-মাবহু হত্যা ইস্যুতে ইউরোপের চার দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড এবং জার্মানির সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘাতকরা ইউরোপীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "আমরা ইউরোপীয় নাগরিকদের পরিচয়পত্র চুরি করে তাদের নামে পাসপোর্ট ব্যবহারের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।" এদিকে অস্ট্রেলিয়ার জাল পাসপোর্ট ব্যবহারের ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত ইসরাইলী রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে তলব করার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড বলেছেন, তার সরকার এ ব্যাপারে নীরব থাকবে না। তিনি আরো বলেছেন, দুবাই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহারের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট জাল করা হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডও তাদের দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে ইসরাইলী রাষ্ট্রদূতকে তলব করে । ব্রিটেন ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরাইলকে অভিযুক্ত না করলেও ঘাতকদের মাধ্যমে ছয় বৃটিশ নাগরিকের জাল পাসপোর্ট ব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে ইসরাইলী রাষ্ট্রদূতের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন ইসরাইলি দূতকে তলব করে জাল আইরিশ পাসপোর্ট ব্যবহারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হত্যার নির্দেশদাতা খোদ ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুবাইয়ে হামাস নেতা মাহমুদ আল মাবহু'কে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে খবর পাওয়া গেছে। টাইমস অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে নেতানিয়াহু তেলআবিবে ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সদর দপ্তরে যান। সেখানে তিনি মোসাদ প্রধান মির দেগানের সাথে বৈঠক করেন এবং সে সময় মোসাদের ঘাতক বাহিনীর কয়েক সদস্য উপস্থিত ছিলো। মোসাদ সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বৈঠকে নেতানিয়াহু হামাস নেতাকে হত্যার প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন। মাহমুদ আল মাবহু দুবাই সফরে আসবেন বলে খবর পাওয়ার পর মোসাদের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এর আগেই ঘাতক বাহিনী তেলআবিবের একটি হোটেলে হত্যাকাণ্ডের রিহার্সেল দেয়। এরপর ২০শে জানুয়ারি হামাস নেতা দুবাইয়ের একটি বিলাসবহুল হোটেলে গুপ্তহত্যার শিকার হন। হামাস নেতা খুন নিয়ে যখন দুবাই, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে টান টান উত্তেজনা চলছিল তখনই ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন ইসরাইলের বিরোধী দলীয় নেত্রী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিপি লিভনি। লিভনি হামাস নেতা হত্যার ঘটনার প্রশংসা করে বলছেন, সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্যই এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন করা উচিত৷ এর আগে হামাসের শীর্ষ নেতা শেখ ইয়াসিন ও আবদুল আজিজ রানতিসিকে হত্যার পর ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন সাংবাদিকদের ডেকে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেছিলেন, 'আমি রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব হামলা পরিচালনা করেছি৷ এধরনের হামলা অব্যাহত থাকবে ৷ আমাদের অভিযান বন্ধ হবে না।' হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিটেন অবহিত ছিল হামাস নেতা মাহমুদ আল মাবহুকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিটেন অবহিত ছিল বলে বৃটিশ দৈনিক ডেইলি মেইল খবর দিয়েছে। দৈনিকটির ১৯ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় লেখা হয়েছে, ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ বৃটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে দুবাইতে হত্যাকাণ্ড ঘটাবে এই তথ্য বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম আই-সিক্সকে আগেই অবহিত করা হয়েছিল। মোসাদের একজন এজেন্টের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি এ খবর প্রকাশ করেছে। তবে বৃটেনের একটি নিরাপত্তা সূত্র বলেছে, মোসাদ বৃটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে তাদের অভিযান চালানোর কথা জানালেও কাকে হত্যা করা হবে,তা উল্লেখ করেনি। এর দুদিন আগে অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি সূত্রে বরাত দিয়ে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ দুবাইয়ে হামাস নেতা মাবহুকে হত্যা করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মোসাদ এজেন্টরা যেহেতু ব্রিটিশ পাসপোর্টও ব্যবহার করেছেন, তাই লন্ডন কর্তৃপক্ষ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ব্যাখ্যা চেয়েছে। অথচ সবাই জানে যে, ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা ও তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতার পেছনে ব্রিটেনের অবদান সবচেয়ে বেশী। গ্রেফতার হতে পারেন নেতানিয়াহু হামাস নেতা হত্যায় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও মোসাদ প্রধান জড়িত থাকার বিষয়ে দুবাই পুলিশ নিশ্চিত হবার পর পুলিশ প্রধান দাহি খালফান তামিম তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, দুবাই পুলিশ হামাস নেতা হত্যাকাণ্ডের দায়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির যে আবেদন জানিয়েছে, তেলআবিব সে ব্যাপারে নীরবতা পালন করছে। খালফান বলেছেন, মাবহুকে হত্যার পর তার দুই ঘাতক যুক্তরাষ্ট্রে এবং বাকিরা ইসরাইলে আশ্রয় নিয়েছে। যেসব ঘাতক ইসরাইলে আশ্রয় নিয়েছে তারা অন্য দেশে যাওয়া মাত্রই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে তিনি জানান। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল দুই দফায় ২৭ ঘাতকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির লক্ষ্যে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে নোটিশ পাঠিয়েছে। ইসরাইল ও তার মিত্রদের করণীয় দুবাইয়ে হামাস নেতা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ঘাতকরা ইউরোপের কয়েকটি দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করায় ফ্রান্স, ব্রিটেন, আয়ারল্যাণ্ড ও জার্মানী ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ইউরোপ ও আমেরিকার প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন, সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই ইসরাইল অব্যাহতভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কারণেই গাজায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরও ইসরাইলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কিছুই করতে পারছে না। ইউরোপের দেশগুলো যদি সত্যিই ইসরাইলের ওপর নাখোশ হয়ে থাকে তাহলে তাদের উচিত তেলআবিবকে সবধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়া বন্ধ করা। যুদ্ধাপরাধ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দায়ে ইসরাইলী কর্মকর্তাদের বিচারের সম্মুখীন করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। আর ইসরাইলী নেতাদেরও মনে রাখা উচিত, ফিলিস্তিনী নেতাদের হত্যা করে ইসরাইল বিরোধী গণ-আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।

Tuesday, January 19, 2010

ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার ও জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে 'বাংলা'র অন্তর্ভূক্তি দাবী

বর্তমান বিশ্বের সাড়ে ৬০০ কোটি মানুষ প্রায় ৬ হাজার ভাষায় কথা বলে। তবে ভাষাতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, আগামী একশ বছরের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ অতীতেও অনেক ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। একসময় পাশ্চাত্যের একটি বিখ্যাত ভাষা ছিল ‘ল্যাটিন’ । কিন্তু এ ভাষায় এখন আর কেউ কথা বলে না। ভারতীয় উপমহাদেশের এমন একটি ভাষার নাম ‘সংস্কৃত’ । ধর্মীয় কাজের বাইরে এর কোন ব্যবহার নেই। মধ্যযুগে ব্রিটেনের একটি ভাষা ছিল ‘কর্নিশ’। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত একজন মহিলা জীবিত ছিলেন যিনি ঐ ভাষায় কথা বলতেন। তার মৃত্যুর পর ঐ ভাষাটিও বিলুপ্ত হয়ে যায় । ‘The languages of the world’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৬ হাজারের মতো ভাষা আছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ অর্থাৎ শ'তিনেক ভাষায় পৃথিবীর ৯৬ ভাগ মানুষ কথা বলে। বাকী সাড়ে পাঁচ হাজার ভাষার মধ্যে যেসব ভাষায় কথা বলার লোক এক লাখের বেশী নেই, সেগুলোর মধ্যে বেশকিছু ভাষা এখন বিলুপ্তির পথে। এক হিসেবে দেখা গেছে, আজকের পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে এমন ৫১টি ভাষা আছে যেগুলোর প্রতিটিতে মাত্র একজন করে ব্যবহারকারী রয়েছে! এ চিত্র থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে, বিশ্বের জীবন্ত ভাষাগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এই বিলুপ্তির হার বন্যপ্রাণী কিংবা গাছপালা বিলুপ্তির হারের চেয়েও বেশী। কিন্তু বাংলাভাষার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বিশ্বে বাংলা ভাষার অবস্থান বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২৬ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষার স্থান ষষ্ঠ। শুধু বাংলাদেশের মানুষই যে এ ভাষায় কথা বলে তা নয় বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মণিপুর, বিহার ও উড়িষ্যা এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও বাংলা ভাষায় কথা বলে। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়নে বাংলাকে ২য় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে সেদেশের জনগণ বাংলাভাষা শিক্ষা করছে। বাংলা ভাষার আন্দোলন বিশ্বে বাংলাই সম্ভবতা একমাত্র ভাষা-যার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলিতে আব্দুস, সালাম,রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র আকার ধারণ করে। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে উর্দুর সম-মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। এছাড়া ’৫২-এর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন। ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষণা দিলে বাঙালীদের ভেতর ক্ষোভ দানা বাঁধে । ক্রমশঃ তা আন্দোলনে রূপ নেয় । ১৯ মে শিলচরে সকাল ৬টা-সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করে। বেলা সাড়ে তিনটায় ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ পালন করছিল তখন আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলবর্ষণ করলে ঘটনাস্থনে প্রাণ হারান ১১জন ভাষাবিপ্লবী। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। বাংলা ভাষার প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে বাঙালীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ইউনেস্কোর নজরে আনার জন্য কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’ প্রচেষ্টা শুরু করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়। ওই দিন ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি জানানোর প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং অপর ২৫টি দেশের সদস্যরা সেটিকে অনুমোদন করে। এরপর থেকে সারা বিশ্বে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।' ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৮ সালের গত ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র দফতর ‘শান্তির জন্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি রেজুলেশন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তুলে ধরে। ভারত, জাপান, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের ১২৪টি দেশ এই রেজুলেশনটি সমর্থন করে। এই রেজুলেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এবং শান্তির জন্য সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির সংলাপকে উৎসাহিত করতে মাতৃভাষাগুলোর অবদানের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা করার দাবি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ ভাষা শহীদদের প্রতি নিঃসন্দেহে ব্যাপক সম্মান দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এতেই কি সন্তুষ্ট ? মোটেই না। আর এ জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সদস্য দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছেন । ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাংলাদেশের ভাষা শহীদরা জীবন দিয়েছিলেন। সেদিনের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতি বছর এই দিন ইউনেস্কো বিশ্বের সকল ভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দিবসটি পালন করে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের পার্লামেন্ট জাতিসংঘকে অনুরোধ করেছে বাংলাকে এর অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য। ভাষার শক্তির প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে আমি সকল সম্মানিত সদস্যের সমর্থন কামনা করছি।’ বাংলাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবির সাথে একমত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত ২১শে ডিসেম্বর ২০০৯ জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিসংবলিত একটি সর্বদলীয় প্রস্তাব পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার হাসিম আবদুল হালিম। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এখন ছয়টি ভাষা স্বীকৃত। এসব ভাষা হলো- ইংরেজি, চাইনিজ, আরবি, ফরাসি, রাশিয়ান ও স্প্যানিস। এর মধ্যে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে বিশ্বের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ এবং বিশ্বের প্রায় ২২ কোটি মানুষ আরবিতে কথা বলে । কিন্তু বাংলায় কথা বলে প্রায় ২৬ কোটি মানুষ। ফলে রুশ ও আরবি যদি জাতিসংঘের অফিশিয়াল ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে তাহলে বাংলা কেন পারবে না? সরকার যদি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে তাহলে একদিন না একদিন বাংলাভাষা অবশ্যই জাতিসংঘের অফিশিয়াল ভাষার স্বীকৃতি পাবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলা ভাষা বর্তমানে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন, ও ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে বাংলা ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ,ভারত ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানী, চীন, ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ফিলিপাইন,জাপান প্রভৃতি দেশ থেকে প্রতিদিনই বাংলা ভাষায় রেডিও অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়ে থাকে। এছাড়া ব্রিটেন, কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্যোগে টিভি অনুষ্ঠানও প্রচার করা হচ্ছে। এসব রেডিও, টিভির অনুষ্ঠান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষীরা উপকৃত হচ্ছেন। ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া বর্তমান যুগে কোন দেশই অগ্রসর হতে পারবে না। আর একারণেই ভাষাপ্রেমী প্রযুক্তিবিদরা তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছেন। বাঙালী প্রযুক্তিবিদদের প্রচেষ্টায় বর্তমানে ফায়ারফক্স ব্রাউজার,ওপেন অফিস, জুমলা,গুগল, লিনাক্স, উবুন্টু এসব বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা হয়েছে। ওয়েব ব্রাউজার মজিলা সম্প্রতি আটটি ভাষাতে বেটা সংস্করণ অবমুক্ত করেছে। এই আটটি ভাষার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও আছে। এর ফলে এখন থেকে আমরা বাংলা ভাষার ইন্টারফেসের ফায়ারফক্স ব্যবহার করতে পারবো। ফায়ারফক্সে এখন বাংলা অভিধানও যুক্ত আছে। সেটি সক্রিয় করে বাংলা লিখলে লেখার সময় বানানে ভুল হলে সতর্ক করা হয়। গুগলের দারুণ দারুণ সব সার্ভিস সম্পর্কে আমরা কে না জানি! গুগল সার্চ ইঞ্জিনে বাংলা অনেক আগে থেকে যুক্ত হলেও সার্চের সময় বাংলা অটো-কমপ্লীট যুক্ত হয়েছে কিছুদিন আগে। গুগলের আর একটি ভাল সার্ভিস হচ্ছে google transliteration, যে সব সাইটে বাংলা লেখার ব্যবস্থা নেই, সে সব ওয়েব ব্রাউজারে খুব সহজেই বাংলা লেখা সম্ভব। গুগল ট্রান্সলেটরে বাংলা ভাষা না থাকলেও গুগল অভিধানে সম্প্রতি বাংলা ভাষা যুক্ত হয়েছে। বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় সোসাল সাইট ফেসবুকেরও বাংলা রূপান্তর করা হয়েছে। ব্লগার ডট কম আংশিক বাংলা ভার্সন তৈরি হয়েছে প্রায় বছর খানেক আগেই। সম্প্রতি এ কার্যক্রম তাদের জনপ্রিয় মেইল সার্ভিসেও প্রয়োগ করেছে। বলতে গেলে পুরো বাংলাতেই এখন কম্পিউটারের অনেক কিছু ব্যবহার করা সম্ভব। উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়ায় বাংলা ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় তথ্যভাণ্ডার হচ্ছে বাংলা উইকিপিডিয়া। ইন্টারনেটে মুক্ত বাংলা বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের সংখ্যা ২০ হাজার অতিক্রম করেছে। প্রসঙ্গত ২০০৪ সালে বাংলা উইকিপিডিয়ার কাজ শুরু হলেও শুরুতে এর অগ্রগতি ছিল ধীরগতির। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের বাংলা উইকি দল গঠনের পর থেকে দ্রুত এটি বিস্তৃত হতে থাকে। এখানে বাংলা ভাষার ইতিহাস,বাংলা বর্ণের উৎপত্তির বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের দিনপঞ্জিও রয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি বিশ্বকোষ হলো বাংলাপিডিয়া। ২০০৩ সালে ১০ খন্ডে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই এটি ছাপা হয়। এছাড়া এর ইলেকট্রনিক সংস্করণও প্রকাশিত হয়। এখানে প্রায় ১২০০ লেখকের লেখা স্থান পেয়েছে। ওয়েবসাইটেও এসব তথ্য বিদ্যমান। বাংলা ভাষা, ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে বাংলায় প্রচুর তথ্য রয়েছে। প্রয়োজন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার অমর একুশকে জাতিসংঘের স্বীকৃতি, সিয়েরা লিয়নে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদাদান এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার বহুল ব্যবহারের পরও বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চার ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষজন আঞ্চলিক বাংলায় কথা বললেও শহরাঞ্চল বিশেষকরে রাজধানী কোলকাতার অধিকাংশ বাঙালী ইংরেজি ও হিন্দির চর্চা করে। ফলে বাংলা ভাষা সেখানে আত্মাহুতি দেয়ার মুখে। এ দিকটি লক্ষ্যে করেই ভারতের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, “আগামী পঞ্চাশ বছর পরে বাংলা ভাষার চর্চা হবে কেবলমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক।” সুনীল বাবুর বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা যথার্থ কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ খোদ বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে ভাষার ব্যবহার এখনও চালু হয়নি । উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা এখনও উপেক্ষিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষার চর্চা নেই। অনার্স, মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি কোর্স কোথাও বাংলা সাহিত্যের জায়গা নেই। অথচ মহান ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো- ‘অফিস আদালতে সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করতে হবে । আমাদের সংবিধানের প্রথমেই শেখা আছে,‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু তারপরও সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু এবং ‘শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা’ চালু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোন উদ্যোগ এখনো নেই। নিজ দেশের সর্বত্র যদি আমরা বাংলা ভাষার ব্যবহার না করতে পারি তাহলে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভূক্তির চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।