Wednesday, July 30, 2008

হিজবুল্লাহর বিজয়ের নেপথ্যে-২

গত ১৬ জুলাই ছিল লেবাননের জনগণ ও সেদেশের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। সেদিন ইসরাইল লেবাননী শহীদ ও বন্দীদেরকে ফেরত দিয়েছিল। পক্ষান্তরে লেবানন ইসরাইলের ২ মৃত সেনার লাশ ইসরাইলকে ফেরত দিয়েছে। বন্দী বিনিময়ের এই ঘটনাকে লেবাননের হিযবুল্লাহর ঐতিহাসিক বিজয় বলে মন্তব্য করেছে স্বয়ং অধিকৃত ফিলিস্তিনের দৈনিক ইয়াদিউত অহরুনুত।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধের সাম্প্রতিক বিজয়ের বিভিন্ন দিক রয়েছে।ইসরাইল সবসময়ই নিজেদের গোয়েন্দা বিভাগের পটুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কথা বলে এবং ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার ক্ষেত্রে তাদেরকে কাজে লাগায়। কিন্তু বন্দী বিনিময় এবং লেবাননী শহীদদের লাশ ফেরত দেওয়ার ঘটনায় ইসরাইলী এই গোয়েন্দা বিভাগ মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা লেবাননের হিযবুল্লাহর কাছে ইসরাইলীদের যে দুই সেনা ছিল,তারা যে যুদ্ধ চলাকালে আহত হবার পর মারা গিয়েছিল সেই তথ্য তাদের জানা ছিল না। তারা ভেবেছিল তাদের ঐ ২ সেনা জীবিত আছে।
অপরদিকে ইসরাইল বাধ্য হয়েছে তাদের ২ সেনাকে ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে ৫ জন বন্দী এবং লেবাননী-অলেবাননী ২০০টি লাশ হিযবুল্লাহর হাতে বুঝিয়ে দিতে। এ কারণে তেলাবিবের অনেক কর্মকর্তা বন্দী বিনিময়ের দিনটিকে ইসরাইলের ইতিহাসে একটি কালো দিবস বলে উল্লেখ করেছে। ইসরাইলের যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন-'বন্দী বিনিময় ইসরাইলের দুর্বলতাকে সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।' তিনি তাই ইসরাইলী গণমাধ্যমগুলোকে বলেছেন বন্দী বিনিময়ের খবরটিকে যেন ফলাও করে না ছাপে। এ সম্পর্কে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টও লিখেছে ইসরাইলের এই পরাজয়ের ঘটনা বিশ্বব্যাপী এবং ইসরাইলের অভ্যন্তরেও তাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে। বিশ্বের আরো বহু দৈনিকও ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের হিযবুল্লাহর ঐতিহাসিক বিজয়কে ফলাও করে তুলে ধরেছে। কোনো কোনো পত্রিকা এটাকে লেবানননের জাতীয় বিজয় বলেও মন্তব্য করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান-কি মুন এবং বিশ্বের বহু দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের এই বিজয়ে সেদেশের জনগণ ও প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দিত করেছে। এই বিজয়ের ফলে আরো যে বিশাল সাফল্য অর্জিত হয়েছে তাহলো,লেবাননের অভ্যন্তরে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছে।হিযবুল্লাহর উপমহাসচিব শায়েখ নাঈম কাসেম দৈনিক আল-আরাবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন-'বন্দী বিনিময়ের ঘটনা একদিকে যেমন লেবাননের জনগণের মাঝে ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে,তেমনি এর ফলে বন্দীদেরকে মুক্ত করার ব্যাপারে লেবাননী জনগণ ও সরকার যে আন্তরিক তা-ও প্রমাণিত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাটি লেবাননের অভ্যন্তরে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।'
বন্দী বিনিময়ের ফলে আরো যে বিষয়টি হিযবুল্লাহর জন্যে ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তাহলো,এর ফলে প্রমাণিত হলো যে হিযবুল্লাহ তাদের সেনাদের ব্যাপারে এমনকি শহীদদের লাশের ব্যাপারেও ভীষণ আন্তরিক ও দায়িত্বশীল।তারা যে মানবিক বিষয়গুলোর কথা ভুলে যায় না-এরফলে তাও প্রমাণিত হলো। শহীদদের লাশ ফিরে পেয়ে শহীদ পরিবারের লোকজন ভীষণ খুশি হয়েছে। তারচেয়েও বেশি খুশি হয়েছে সেইসব পরিবার যারা বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করার পর বন্দীদেরকে তাদের মাঝে জীবিতাবস্থায় পুনরায় ফিরে পেয়েছে। যারা শহীদ হয়েছে কিংবা বন্দী ছিল,তাদের মাঝে হিযবুল্লাহর বাইরেও অন্যান্য দলের সদস্য ছিল।
এ থেকে বোঝা যায় যে হিযবুল্লাহ কেবল স্বার্থপরের মতো নিজেদের শহীদদের ব্যাপারেই তৎপরতা চালায় নি বরং তারা দল-মত নির্বিশেষে পরিপূর্ণ ইসলামী মানবিক আচরণ করে সকল বন্দীর জন্যেই সমানভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। সামির কান্তারের মুক্তিই তার প্রমাণ। কেননা সামির কান্তার ৩০ বছর আগে অর্থাৎ হিযবুল্লাহ নামক সংগঠনটি গঠিত হবারও আগে ইসরাইলীদের হাতে বন্দী হয়েছিল। তাকে মুক্ত করার জন্যে হিযবুল্লাহ যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে,সেই প্রচেষ্টার ফলে সামির কান্তার এতো বেশি প্রভাবিত হয়েছে যে,সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে তিনি তাঁর নেতা এবং শিক্ষক বলে মন্তব্য করতেও কুণ্ঠিত হন নি। তিনি বলেছেন-তাঁর ভাষায়-'গতকাল পর্যন্ত শত্রুদের হাতে বন্দী ছিলাম,কিন্তু আজ থেকে আরো বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো।'
মজার ব্যাপার হলো,হিযবুল্লাহ অন্যান্য দেশের বন্দীদের মুক্তির জন্যেও বিশেষ করে ফিলিস্তিনী বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে হিযবুল্লাহ নেতা জনাব হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, 'বন্দী বিনিময়ের ক্ষেত্রে ইসরাইলীদের হাতে বন্দী ফিলিস্তিনীদের মুক্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্যেও আমরা জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। জাতিসংঘকে লেখা আমাদের চিঠিপত্রগুলোতে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিধৃত আছে।' লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিযবুল্লাহ,আরব লীগকেও অনুরোধ করেছে,তারা যেন ইসরাইলীদের কারাগারে বন্দী আরব ও ফিলিস্তিনীদের মুক্তি দেওয়ার জন্যে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানায়।
ইসরাইলী কারাগার থেকে মুক্ত বন্দীদের অভ্যর্থনা জানানোর অনুষ্ঠানে হিযবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন-'সকল প্রতিরোধ আন্দোলন এবং এ অঞ্চলকে জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্ত করার জন্যে যারাই চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,তাদের পরিচয়, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আসলে এক এবং অভিন্ন,তাহলো-দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা'।লেবাননের জনগণ অত্যন্ত সচেতনতা এবং বিচক্ষণতার সাথে এই প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। এই সংগ্রামের মাধ্যমেই হিযবুল্লাহ ইসরাইলকে পতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে অত্যাচারীদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা এবং নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে লেবাননের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন ইরাক কিংবা ফিলিস্তিনের মতো দখলদারদের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশগুলোর জন্যে সফলতার এক অনন্য আদর্শ ও নিদর্শন। #

Thursday, July 24, 2008

হিযবুল্লাহর বিজয়ের নেপথ্যে-১

গত ১৬ জুলাই ছিল লেবাননের জনগণ ও সেদেশের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিন। লেবাননের হিযবুল্লাহ জার্মান সরকারের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে পরোক্ষভাবে দীর্ঘ আলোচনার পর তাঁদের ৫ জন বন্দী এবং অন্তত ২০০ শহীদের লাশ দেশে ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে হিযবুল্লাহ ইসরাইলী ২ সেনার লাশ অধিকৃত ফিলিস্তিনে ফেরত পাঠিয়েছে। ইসরাইল ভেবেছিলো তাদের ঐ সেনা জীবিত আছে।এর মধ্য দিয়ে বিগত ৮ বছরে ইসরাইলের মোকাবেলায় হিযবুল্লাহর তৃতীয় বিজয় অর্জিত হলো। এরফলে ইসলামী গণআন্দোলন হিযবুল্লাহ ইসরাইলের সামনে তাদের শক্তিমত্তাই প্রমাণ করলো। হিযবুল্লাহ তাদের এই অভিযানকে ক'মাস আগে সিরিয়ায় ইসরাইলী গোয়েন্দাদের হাতে শহীদ ইমাদ মুগনিয়ার নামে নামকরণ করেছে। মুগনিয়া হাজ্জ্ব রেজোয়ান নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। সেজন্যে এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে রেজোয়ান অভিযান। যাই হোক হিযবুল্লাহর এই মহান অর্জনকে নিয়ে আমরা আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো। ইসরাইলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেবাননের সাথে বন্দী বিনিময়ের দিনটিকে তাদের দেশের জন্যে শোক দিবস বলে মন্তব্য করেছেন।ইসরাইলী দৈনিক ইয়াদিউত অহরুনুত এ সম্পর্কে লিখেছে, 'ইসরাইলীরা বেদনার অশ্রু ঝরাচ্ছে আর লেবাননীরা ঝরাচ্ছে গর্ব ও আনন্দের অশ্রু।' ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের কর্মীরা বছরের পর বছর ধরে সংগ্রাম চালাবার পর ২০০০ সালের মে মাসে প্রথমবারের মতো ইসরাইলী সেনাদেরকে দক্ষিণ লেবানন থেকে তাড়াতে সক্ষম হয়। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে ইসরাইলী সেনারা হিযবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় লেবাননের ওপর হামলা চালায়। কিন্তু ৩৩ দিন যুদ্ধ করার পর লেবাননের জনগণ এবং হিযবুল্লাহর পর্বত কঠিন প্রতিরোধের মুখে ইসরাইল মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং তাদের নৃশংস হামলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের হিযবুল্লাহর তৃতীয় বিজয় অর্জিত হয় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিযবুল্লাহর শহীদদের লাশ এবং বন্দীদের ফেরত আনার মাধ্যমে। বিগত কয়েক মাস ইসরাইলের সাথে আলোচনাকালে তারা লেবাননী বন্দী ও শহীদদের লাশ ফেরত দিতে অস্বীকার করে আসছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিযবুল্লাহর চাপের মুখে তারা কেবল লেবাননী শহীদদের লাশ এবং বন্দীদেরকেই ফেরত দিতে বাধ্য হয় নি বরং বন্দী বিনিময়ের পূর্ব মহূর্ত পর্যন্ত তারা জানতেও পারে নি যে তাদের ঐ দুই সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয়েছে। হিযবুল্লাহর বিজয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি সামনে আসে তাহলো অন্যান্য আরব দেশ সুসজ্জিত সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত এ ধরণের বিজয় অর্জন করতে পারলো না! ইসরাইলের বিরুদ্ধে হিযবুল্লাহর বিজয়ের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো,হিযবুল্লাহর মুমিন সংগ্রামীদের আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরতা এবং তাদের মুজাহিদদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য। এ কারণেই হিযবুল্লাহর পতাকায় কোরআনের একটি শ্লোগান নজরে পড়বে। শ্লোগানটি হলো ‌'জেনে রাখো, নিঃসন্দেহে হিযবুল্লাহ বিজয়ী।' এছাড়াও হিযবুল্লাহ তার প্রতিষ্ঠার ২৬ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখিয়ে দিয়েছে যে,তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থে নয় বরং লেবাননের জনগণকে ইসরাইলী আধিপত্য ও নির্যাতন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যেই সংগ্রাম করে। এই সংগঠনটি জনকল্যাণমূলক কাজে কীভাবে আত্মনিবেদিত তা লেবাননবাসী খুব ভালো করেই জানে। হিযবুল্লাহ নিরীহ-বঞ্চিতদের সাহায্যে তাদের হাত সবসময় বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণেই হিযবুল্লাহর প্রতিরোধ আন্দোলন কেবল শিয়াদের কাছেই নয় বরং লেবাননের আহলে সুন্নাত,খ্রিষ্টান এবং দ্রুযদের কাছেও সমানভাবে জনপ্রিয়। হিযবুল্লাহর প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সমর্থনও ইসরাইলের বিরুদ্ধে হিযবুল্লাহর বিজয়ের আরেকটি প্রধান কারণ। দক্ষিণ লেবানন দখলের বছরগুলোতে এবং ২০০৬ সালে ৩৩ দিনের যুদ্ধের সময় লেবাননের জনগণ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হিযবুল্লাহকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা মোটেও পিছপা হয় নি। লেবাননের জনগণ তাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে নিজেদের সন্তান বলে মনে করে।কেননা; তারা তাদের জীবনোৎসর্গ করে তাদের ধর্ম,দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্যে সংগ্রাম করে। এসবের বাইরেও হিযবুল্লাহর বিজয়ের পেছনে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর মতো সচেতন, সৎ, বিচক্ষণ ও দেশপ্রেমিক নেতারও যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে প্রকাশিত দৈনিক মাআরিভ হিযবুল্লাহ এবং ইসরাইলের মধ্যে বন্দী বিনিময় সম্পর্কে লিখেছে-'ইসরাইল পরাজিত হয়েছে এবং হিযবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর ভাবমূর্তি ব্যাপক শক্তিশালী হয়েছে। ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ আরব বিশ্বের এক নম্বর নেতার শিরোপা অর্জন করেছেন। এই মহান স্বীকৃতি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। #

Saturday, July 19, 2008

ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে মহিলাদের হিজাব রক্ষার দাবী

তুরস্কের ইসলাম বিদ্বেষী ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী সেদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়েদের হিজাব বা ইসলামী শালীন পোশাক পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার হঠকারি দাবী এখনও অব্যাহত রেখেছে। ক্ষমতাধর এই ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী নিজেকে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার উত্তরসূরী বলে মনে করে। তুরস্কের ধর্ম নিরপেক্ষ মহল জেনারেল কেনান এভরানের নেতৃত্বে ১৯৮২ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করে । ক্ষমতা দখলের পর তারা সেখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের হিজাব বা পর্দার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তুরস্কে মহিলাদের মধ্যে হিজাব বৃদ্ধি পাওয়ায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মধ্যে হিজাব ছড়িয়ে পড়ায় ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা এই পদক্ষেপ নেয়। এ পদক্ষেপের ফলে হাজার হাজার তুর্কী মহিলা ও মেয়েরা শিক্ষার এবং চাকরীর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তুরস্কের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ জনগণ মুসলমান। বিগত ৮০ বছর ধরে তুরস্কের ইসলাম বিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষ মহল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে এবং ধর্মীয় তৎপরতার ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বসাম্প্রতিক জনমত জরীপে দেখা গেছে, শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী তুর্কী মহিলা হিজাবকে সমর্থন করছে এবং শতকরা ৮৫ ভাগেরও বেশী তুর্কী মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সংসদীয় আইন বাতিল করার বিরোধী। তুরস্কের জনগণ তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য এ পর্যন্ত অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, তারা মহিলাদের হিজাবের সমর্থক জাস্টিস ও ডেভলপমেন্ট পার্টিকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদসহ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী এই দলটি এখন ইসলাম বিদ্বেষী সংখ্যালঘিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ মহলের ক্ষমতার খুটি তথা সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার সম্মুখীন । স্যেকুলার এই গোষ্ঠী বলছে, হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে ক্ষমতাসীন দল কামাল আতাতুর্কের প্রবর্তিত স্যেকুলার মূল্যবোধের বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে। তুরস্কের মুসলিম মহিলারা হিজাব বা পর্দাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য অনেক কস্ট সহ্য করেছে। যেমন, নূরায়ী জানান বাজিরগান নামের এক তুর্কী মহিলাকে হিজাব বা পর্দা মেনে চলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হয়ে দশ বছর ধরে কারাগারে থাকতে হয়েছে। এরপর তিনি বাধ্য হয়ে তুরস্ক ত্যাগ করেন এবং এমনকি তার এক সন্তানকেও হারিয়েছেন। কিছু দিন আগে বেগাম নূরায়ী একজন সমমনা ব্যক্তির সাথে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)কে শ্রদ্ধা করেন কিনা – এ প্রশ্ন করা হলে তিনি ইতিবাচক জবাব দেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ক্বতেহ আলতায়লি এরপর তাকে প্রশ্ন করেন, আতাতুর্ককেও কি ভালবাসেন? উত্তরে বেগাম নূরায়ী বলেন, আমার ওপর যদি কোনো অত্যাচার করা না হয়, তাহলে আমি বলবো , আতাতুর্ককে পছন্দ করি না। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্য তুর্কী মহিলারাও বেগাম নূরায়ীর মতকে সমর্থন জানায়। কিন্তু তুরস্কের ইসলাম বিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষ মহল এ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে। বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান দৈনিক তুর্কী টাইমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র প্রতি তার শ্রদ্ধার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে বলেন, আমার মতে মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) একজন বিজ্ঞ ও জ্ঞানী নেতা এবং একইসাথে তিনি আমাদের বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতীম প্রতিবেশী দেশের নেতা। ইমাম খোমেনী (রঃ) একজন মুমিন মুসলমান এবং তিনি এমন এক আন্দোলনের নেতা ছিলেন যিনি একনায়ক বা স্বৈরাচারি শাহের কাছ থেকে জাতির জন্য গৌরবময় স্বাধীনতা বা মুক্তি এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার আরেকটি কারণ হলো, তিনি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি খুবই সাধারণ মানুষের মতো সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। ইমাম খোমেনী (রঃ) ইরানকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এবং তিনি ইহুদিবাদী ইসরাইলের শত্রু ছিলেন। কিন্তু তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এ অঞ্চল দখলদার ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের বন্ধু এবং তুরস্ক তাদের পরোক্ষ উপনিবেশ মাত্র। তুরস্কে দেশটির ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের সমালোচনা করা বড় রকমের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ জন্য সমালোচককে প্রচারণাগত হামলার শিকার হওয়া ছাড়াও হুমকী এবং গ্রেফতারের শিকার হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামপন্থী, সাহসী ও বীরাঙ্গনা তুর্কী নারী বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান তুরস্কের ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে পছন্দ না করার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, আতাতুর্কের জীবন যাপন পদ্ধতি ও বিশ্বাসের সাথে আমার জীবন যাপন পদ্ধতি ও বিশ্বাসের আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। এ কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব আমার নেই। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আতাতুর্ক ও তুরস্ককে অভিন্ন মনে করেন। তাই আপনার চিন্তাধারা যদি আতাতুর্কের চিন্তাধারার বিরোধী হয় তাহলে তারা আপনাকে তুরস্কের শত্রু বলে তুলে ধরবে। এটাই চরম কামালবাদী বা গোঁড়া আতাতুর্কপন্থীদের যুক্তি। অথচ আতাতুর্কের বিরোধীতা করা বা তার সমর্থন করা আমার স্বাভাবিক অধিকার। তুরস্কের জন্য ইসলামবিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের এ ধরনের আচরণের অর্থ হলো, নীরব থাকো এবং হিজাব ও আতাতুর্কের ব্যাপারে মাথা ঘামিও না। কাউকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে না, বরং কেবল আনুগত্য করে যাও, আমরা যেমনটি চাই তোমার অনুভুতি হতে হবে ঠিক সেরকম। ইসলামপন্থী, সাহসী ও বীরাঙ্গনা তুর্কী নারী বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান আরও বলেছেন, তুরস্কের অনেকেই আতাতুর্কের চিন্তাধারা পছন্দ করেন না, কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস রাখে না। বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান ১৯৯৮ সাল থেকে নিজ ধর্ম ও পর্দা রক্ষা করার জন্য সংগ্রামের কারণেই এ রকম সাহসী হতে পেরেছেন। সে বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে হিজাব পরার কারণে তুর্কী পুলিশ তাকে পরীক্ষার হলে মারধোর করে এবং কারাগারে নিয়ে যায়। তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হিজাবধারী ছাত্রীদের সাথে আলোচনা ও তাদের সাথে যোগাযোগের প্রভাবে বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই পর্দা বা হিজাব বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান আবারও চরম তিক্ত পরিস্থিতির শিকার হন যখন তাকে দ্বিতীয়বারের মতো কারাগারে নেয়া হয়। তীব্র মানসিক নির্যাতন ও দূর্বলতার কারণে তিনি তার যমজ সন্তানের একজনকে হারান। এর পরের বছর নিজের ও পরিবারের ওপর উপর্যপরি হুমকীর প্রেক্ষাপটে বাজিরগান কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে পড়াশুনা অব্যাহত রাখার পর তিনি ২০০৬ সালে আবার তুরস্কে ফিরে আসেন। কারণ তিনি তার মাতৃভূমি তুরস্ককে ভালবাসেন। বেগাম নূরায়ী জানান, বাজিরগানের মতো নারীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ধর্মহীনতাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ইসলামবিদ্বেষী ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি তাঁদের গভীর মমত্ববোধ অটুট ও অম্লান থেকে যায়। তুরস্কের দৈনিক জামানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হিজাব পরিহার করা তার কাছে নিজের মাথা কেটে ফেলার সমতুল্য। এ কারণে ব্যাপক চাপ সত্ত্বেও তিনি তার হিজাব বজায় রেখেছেন। এমনকি তার সাহসী বক্তব্যগুলো পরিহার করে নেয়ার জন্য তাকে বিপুল অংকের অর্থ দেয়ার প্রলোভনও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে তিনি ইসলামী অবস্থানে অনড়ই রয়ে গেছেন। বেগাম নূরায়ী জানান বাজিরগান সঠিক যুক্তি ও পথে উপনীত হবার জন্য ইতিহাসে ফসিল হয়ে পড়া ব্যক্তিদের অনুসরণ না করে পবিত্র কোরআনের অনুসারী হবার আহ্বান জানান। মহান আল্লাহ পোশাকের মাধ্যমে বর্তমান যুগের নারীদের পরীক্ষা করছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। হিজাব করার কারণে তুরস্কের যেসব মহিলা শিক্ষা ও চাকরীর মতো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বাজিরগান বলেছেন, হিজাব সমস্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, অফিস আদালতের কর্মকর্তা এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বেশী মূল্যবান। তুরস্কে হিজাবের পক্ষে দেশটির অধিকাংশ জনগণের সমর্থনের কারণে সেখানে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা খুব বেশী দিন বজায় রাখা সম্ভব হবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।