Wednesday, July 4, 2007

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ'র সাথে হলিউডের সহযোগিতা

সমপ্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি। আই।এ'র কর্মকর্তারা হলিউড-কোম্পানীগুলোর সাথে এক বৈঠকে সি। আই।এ'র দক্ষ কর্মকর্তা পল ব্যারিকে হলিউডের সাথে এই সংস্থার সমন্বয়ক বলে ঘোষণা করেছেন৷ মার্কিন বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ঐ বৈঠকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই.এ' হলিউডকে তার সবচেয়ে দক্ষ ও সাহসী কর্মীদের নামের তালিকা সরবরাহের অনুরোধ করেছে যাতে এই কর্মীদেরকে সি. আই.এ'র লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করা যায়৷ সি. আই.এ'র মুখপাত্র পল কে. লিয়ানো হলিউডের সাথে ঐ বৈঠকে একটি বিবৃতি পড়ে শোনান৷ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই.এ'র কর্মকর্তারা ঐ বিবৃতিতে ঘোষণা করেছেন যে হলিউডসহ অন্যান্য মার্কিন গণমাধ্যমের কর্মতত্‍পরতার ওপর সি আই এ'র সরাসরি নজরদারীর কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে৷ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই.এ দীর্ঘ বহু বছর ধরে নিজ লোকদেরকে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা শিল্পসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়োজিত করে এসব গণমাধ্যমকে দিয়ে পাশ্চাত্যের সমপ্রসারণকামী লক্ষ্যগুলো হাসিলের চেষ্টা করে আসছে৷ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই.এ'র এই কৌশল ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে৷ যদিও মার্কিন চলচ্চিত্র সংস্থা হলিউড নতুন নতুন কৌশল খাটিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছে, কিন্তু এ সংস্থার কাছ থেকে মার্কিন সরকার ও সি. আই.এ'র প্রত্যাশা এখানেই সীমিত নয়৷ মার্কিন সরকার হলিউডকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রত্যাশা মতো অন্যান্য জাতির ওপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চায়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইডিওলজি বা আদর্শ শীর্ষক এক সাড়া-জাগানো নিবন্ধে মিশরীয় বংশদ্ভুত ফরাসী অর্থনীতিবিদ সামির আমিন 'আমাদের মার্কিন বন্ধ'ু জাতীয় শব্দের ব্যাপারে প্রতারিত না হতে তার পাঠকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ মার্কিন সরকার যে কোনো দেশের বন্ধু হতে পারে না তার যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে সামির আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদাহরণ দিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন, "রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইতিহাসের একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল৷ প্রত্যেক দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সেদেশের রাজনীতির নিজস্ব বৈশিষ্টের আলোকে গড়ে ওঠে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও নিউ ইংল্যান্ডের চরমপন্থী গ্রুপগুলোর মাধ্যমে গড়ে উঠেছে৷ তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট হলো: আমেরিকা মহাদেশের স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর গণহত্যা চালানো, ধর্মের অপব্যাখ্যা করে অন্যদেরকে দাসে পরিণত করা, আমেরিকায় অভিবাসী বিভিন্ন জাতি বা সমাজকে আলাদা করা এবং জাতিগত ও গোত্রীয় পার্থক্যগুলোকে বড় করে তুলে ধরা"৷ সামির আমিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আরো লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের লোকেরা ফ্যাসিবাদীদের মতো নিজেকে সর্বোত্তম জাতি বলে মনে করে৷ তারা এও মনে করে যে স্রষ্টা তাদেরকে নিজ ধর্মের বিশ্বাসগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূখ্যাত বর্ণবাদী গোষ্ঠী ক্লু ক্লাঙ্ ক্লান ও ফ্রিম্যাশন গোষ্ঠীর মতো উগ্র গ্রুপগুলোর বিশ্বাস এবং চরমপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরাই শেষ পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই.এ'র ছত্রচ্ছায়ায় একত্রিত হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ও গুপ্ত সংস্থাগুলো চলচ্চিত্রের জগতকেও তাদের চিন্তাধারা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে৷ সামপ্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই. এ নিজ লক্ষ্যের বিরোধী কোনো কোনো ছায়াছবির সমালোচনা করে সেগুলোকে অবাস্তব বলে আখ্যা দিয়েছে৷ হলিউড ও সি আই এ'র মধ্যে সমন্বয়কারী নিয়োগের খবর আপনারা এ আলোচনার শুরুতে জেনেছেন৷ এই নিয়োগের উদ্দেশ্য হলো মার্কিন সরকার ও সি আই এ'র লক্ষ্যের বিরোধী ছায়াছবি নির্মাণের সম্ভাবনা দূর করা৷ হলিউড ও সি আই এ'র মধ্যে সমন্বয়কারী নিয়োগের বৈঠকে এটা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো কোনো ছায়াছবি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সি আই এর চেহারা বিকৃত করে তুলে ধরেছে এবং এরফলে দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে এই সংস্থা সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে৷ অনেক সমালোচক বলছেন, হলিউডে মাঝে মধ্যে এমন দু-একজন স্বাধীনচেতা ফিল্ম-নির্মাতা দেখা যায় যারা বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চান এবং তারা নিজ ছায়াছবিতে বাস্তবতা তুলে ধরছেন৷ স্বাধীন ছায়াছবি নামে পরিচিত এসব ছায়াছবিতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়৷ গুড শেফার্ড বা ভালো রাখাল এ ধরনের একটি ছায়াছবির দৃষ্টান্ত৷ ২০০৬ সালে নির্মিত এ ছায়াছবিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বা সি আই এ গঠনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে৷ গুড শেফার্ড বা ভালো রাখাল শীর্ষক ছায়াছবিটি এডওয়ার্ড উইলসন নামের এক ব্যক্তির জীবন কাহিনীর চিত্ররূপ৷ এই লোকটি সি আই এ গঠনে এবং ৬০'র দশকে মার্কিন এই গোয়েন্দা সংস্থার ধ্বংসাত্মক তত্‍পরতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ গঠনের পটভূমি ও এর বিকাশ এবং এ সংস্থার অতীতের ও বর্তমান লক্ষ্যগুলো এই ছায়াছবিতে মেলোড্রামার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে৷ এ ছায়াছবিতে কিউবার বে অব পিগ বা পিগ উপসাগরে মার্কিন অনুচরদের হামলা এবং এ হামলায় মার্কিনীদের লজ্জাজনক পরাজয়ের কাহিনীও স্থান পেয়েছে৷ ফ্ল্যাশ-ব্যাক বা স্মৃতি রোমন্থন হিসেবে এডওয়ার্ড উইলসনের শৈশব এবং একটি গোপন সংস্থায় তার অন্তর্ভুক্তি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা-সি আই এর গোড়া পত্তনের দৃশ্যগুলো এ ছায়াছবির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক৷ নিরাপত্তার বিষয়ে দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তাহীনতা গুড শেফার্ড বা ভালো রাখাল শীর্ষক ছায়াছবির কেন্দ্রীয় বিষয়৷ রবার্ট ডোনিরো এই ছায়াছবির নির্মাতা৷ আসলে ভালো রাখাল নামের ছায়াছবিতে এটা দেখানো হয়েছে যে, সি আই এর পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচিত সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন সমাজে তথাকথিত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার নামে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোর জন্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে৷ আর এই ব্যক্তিটি তার পেশাগত স্বভাব অনুযায়ী কখনও অন্যদের বিশ্বাস করে না৷ তাই এই লোকটি তার চারপাশেও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে অক্ষম৷ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বা সি. আই.এ'র এই ইতিহাস-ভিত্তিক এই ছায়াছবি অত্যন্ত আকর্ষণীয়৷ এই ছায়াছবির নির্মাতা এমন একটি গোপন সংস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন যা ভয়ানক গোপন সংস্থাগুলোর সমতুল্য এবং এসব সংস্থার রয়েছে নিজস্ব রীতি ও পদ্ধতি৷ আর এই গোপন সংস্থাই পরবর্তীকালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বা সি. আই.এ\'তে রূপ নিয়েছে৷ অবশ্য পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও সেখানকার রূপকথাগুলোতেও দেখা যায়, পশ্চিমা সমাজের সামাজিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতারা এ ধরনের ভয়ানক বা কূখ্যাত গোপন সংস্থা থেকেই উঠে এসেছেন৷ প্রাচীন ইতিহাসবিদ হেরোডটাসও এটা উল্লেখ করেছেন৷ পাশ্চাত্যের এ ধরনের নেতারা অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে ও অনেক শ্রম-সাধনার মাধ্যমে নিজ সংস্থার উচ্চ পদে আসীন হন৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিও বুশও নিজের যুদ্ধকামী বা আগ্রাসী পদক্ষেপগুলোর অজুহাত হিসেবে মার্কিন সমাজের নিরাপত্তার দোহাই দিয়েছেন৷ বিশেষ করে ইরাকে ও আফগানিস্তানে হামলা চালানোর যুক্তি হিসেবে বুশ এ অজুহাতই ব্যবহার করেছেন৷ বুশ তার বক্তব্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে 'মার্কিনী স্টাইলের' নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন বা অন্য কথায় সারা বিশ্বে মার্কিন যুদ্ধকামী নীতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন৷ আর এ জন্যেই বুশ মার্কিন চলচ্চিত্র সংস্থা হলিউডকেও তার সংস্থার একটি শাখায় পরিণত করেছেন৷)

No comments: