গত মঙ্গলবার ছিল জাতিসংঘের ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব দিন৷ এ দিনে জাতিসংঘ এমন এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে নিজেকে ধন্য করেছে যিনি বিশ্বসাহিত্য ও বিশেষ করে অধ্যাত্মিক সাহিত্য অঙ্গনের বা আধ্যাত্মিক কবিকূলের সম্রাট হিসেবে খ্যাত৷ নিউইয়র্কের সন্ধ্যাবেলা যেন সভ্যতার ও নৈতিকতার এক অলৌকিক দিশারীর ৮০০ তম জন্ম-জয়ন্তীর ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত ও হীরন্ময় হয়ে উঠেছিল৷ জাতিসংঘের সদর দপ্তরে অভূতপূর্ব পরিবেশে সেদিন মাওলানা জালাল উদ্দিন বালখী রূমি (রঃ)কে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং বিভিন্ন দেশের চিন্তাবিদ ও মাওলানা রূমির আধ্যাত্মিক কবিতার বহু ভক্ত বা অনুরাগী৷ সারগর্ভ ও চিন্তাউদ্দীপক আলোচনা অনুষ্ঠান ছাড়াও মনোজ্ঞ আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ঐতিহাসিক সন্ধ্যা হয়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত৷
আধ্যাত্মিক কবি-সম্রাট মাওলানা জালাল উদ্দিন বালখী রূমি (রঃ)'র ৮০০-তম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেন, বর্তমান বিশ্ব অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে মাওলানা রূমির চিন্তাধারা প্রচারের মুখাপেক্ষী৷ তিনি আরো বলেন, "মাওলানা রূমীর কাব্যসম্ভারে শান্তি এবং সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের আবেদন বা বাণী প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে৷ আর এই বাণী হওয়া উচিত বিশ্ব সমাজের কর্মতত্পরতা বা আচরণের আদর্শ৷" জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, এই মহান কবির স্মরণ জাতিসংঘে সভ্যতাগুলোর ঐক্যের ধারণাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে৷ এই মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বান কি মুন বলেন, আপনাদের অনেকেই মাওলানা রুমির একনিষ্ঠ ভক্ত বা অনুরাগী৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অনেক ব্যক্তিত্বসহ আপনারা যারা এখানে সমবেত হয়েছেন শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে আমি অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি যে, মাওলানা রূমি তার জন্মের আটশ বছর পর আজও জীবন্ত রয়েছেন৷ এই অনুষ্ঠান মাওলানা রূমির মানবিকতা বা মানব প্রেম, সহিষ্ণুতা, সমঝোতা ও দয়ার দর্শন তুলে ধরার এবং এসব দর্শনের প্রতি সম্মান জানানোর এক সূবর্ণ সুযোগ বয়ে এনেছে৷ বান কি মুন তার ভাষণে আরো বলেছেন, জাতিসংঘে মাওলানা রূমীর ৮০০ তম জন্মজয়ন্তী উদযাপনের আয়োজকরা যেমনটি আশা করছেন আমিও ঠিক সেভাবেই আশা করছি যে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব হাসিমুখে ও বিনম্রভাবে পালন করতে সক্ষম হব৷ যদিও আমি জানি যে এটা খুবই কঠিন দায়িত্ব, তবুও মাওলানা রূমি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন তারই আলোকে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী৷ জাতিসংঘের মহাসচিব এরপর বলেন, মাওলানা রূমির কবিতা কোনো একটি যুগ বা কালের গন্ডীতে সীমিত নয়, তবুও জাতিসংঘে মাওলানা রূমির কবিতার উত্সব অত্যন্ত উপযুক্ত সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ বিভিন্ন জাতি ও সমাজের মধ্যে সামপ্রতিক যুগে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা তাদের মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব সৃষ্টি করেছে এবং পারস্পরিক অসহিষ্ণুতাসহ সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে৷ বিশ্বে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্যে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো অত্যন্ত জরুরী৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তার ভাষণে আরো বলেছেন, "এইসব মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে আমাদের প্রত্যেককেই ব্যক্তি-স্বার্থের ব্যাপারে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে৷ মাওলানা রূমীর রেখে যাওয়া শিক্ষা অনুযায়ী আমাদেরকে অবশ্যই জনগণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং তাদেরকে বিধাতার সৃষ্টি ও মানুষ হিসেবে ভালবাসতে হবে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আরো বলেন, মাওলানা রূমীকে স্মরণ বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এই অনুষ্ঠান বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষকে ঘনিষ্ঠ করার অশেষ গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন করছে এবং এভাবে আমরা মাওলানার বিশ্ব দর্শনকে কাজে লাগাতে পারি৷ আর জাতিসংঘের উদ্যোগে এ ধরনের অনুষ্ঠান সভ্যতাগুলোর ঐক্যের মাধ্যমে শান্তির সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার জন্যে সহায়ক হবে৷"
জাতিসংঘে আধ্যাত্মিক কবি-সম্রাট মাওলানা জালাল উদ্দিন বালখী রূমি (রঃ)'র ৮০০-তম জন্মজয়ন্তীর মহতী অনুষ্ঠানে ইরান, আফগানিস্তান, তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাবিদসহ জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও বক্তব্য রেখেছেন৷ এই অনুষ্ঠানের আলোচনা বা গবেষণামূলক পর্বে বিভিন্ন দেশের বক্তারা ফার্সীভাষী এই আধ্যাত্মিক মহাকবির জীবনের সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক বা জ্ঞানগত দিকের বিশ্লেষণ করেছেন৷ জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বে ইরান, আফগানিস্তান ও তুরস্কের শিল্পীরা মাওলানা রুমি (রঃ)'র আধ্যাত্মিক বা মরমী কবিতা সংগীত ও গানের মাধ্যমে পরিবেশন করেন৷ এ ছাড়াও মার্কিন সরকার মাওলানা রূমি (রঃ)'র ৮০০ তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করেছে৷ এ ডাক টিকেটে মাওলানা রূমির ছবি স্থান পেয়েছে৷ এই ছবির শিল্পী হলেন ইরানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হোসাইন বেহজাদ৷ ওদিকে দুঃখজনক ঘটনা হলো, মার্কিন সরকার এবারসহ বেশ কয়েকবার ইরানী শিল্পীদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের ভিসা দেয়নি৷ ফলে ইরানের সংগীত দল জাতিসংঘের এই বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারে নি৷
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালকে জাতিসংঘ রুমী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন বালখী রূমি (রঃ)'র সংক্ষিপ্ত
ফার্সী ভাষায় মৌলভী হিসেবে সুপরিচিত জালালউদ্দিন মোঃ বালখী রুমী (রঃ) ইরানের বিখ্যাত সুফী-সাধক, আরেফ ও কবি৷ তিনি উত্তর ইরানের বালখে হিজরী সপ্তম শতকে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন৷ তার পিতার নাম বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ৷ বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন একজন বিখ্যাত শিক্ষক ও আরেফ৷ রূমির পিতা তার সন্তানের সুশিক্ষার দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ ইরানের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলগুলোয় মোঙ্গলদের হামলা, গণহত্য ও তাদের লুটতরাজ বা ধ্বংসযজ্ঞ জোরদার হওয়ায় অনেক ইরানী পন্ডিত বা চিন্তাবিদ ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ ঐ পরিস্থিতিতে মাওলানা রূমী (রঃ)'র পিতাও পবিত্র কাবাঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সিরিয়া ও হিজাজে যাবার সিদ্ধান্ত নেন৷ মাওলানা রূমী (রঃ)'র পরিবার কিছুকাল বাগদাদ ও নিশাপুরে থাকার পর সিরিয়া ও হিজাজে যান৷ এরপর তারা মধ্য এশিয়ার লারান্দে ও সেখান থেকে বর্তমান তুরস্কের কুনিয়ায় যান৷ রূমি (রঃ) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কুনিয়াতেই ছিলেন৷ মাওলানা রূমী (রঃ) তাঁর পিতা ছাড়াও সেযুগের অনেক বিখ্যাত শিক্ষকের সানি্নধ্য লাভ করেছিলেন৷ পিতার মৃত্যুর পর মাওলানা রূমী (রঃ) তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত হন৷ অসাধারন জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং আকর্ষণীয় গল্প ও কাব্যরসে সমৃদ্ধ তাঁর ভাষণ বা ক্লাসগুলো বিপুল সংখ্যক তত্ত্ব-পিপাসু ও জ্ঞানপিপাসুকে আকৃষ্ট করেছিল৷ সাত বৈঠক বা মাজালেসে সাবআ এবং ফি মা ফি শীর্ষক গ্রন্থ মাওলানা রূমি (রঃ)'র ভাষণ ও ক্লাসের ফসল৷ মসনভী ও দিওয়ানে শামস তাঁর দুটি অমর কীর্তি৷ মাওলানা রূমী হিজরী ৬৭২ সালে ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন৷ কিন্তু তিনি আজো বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন তাঁর অমর কাব্য ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা বা আদর্শের অক্ষয় কীর্তির মধ্যে৷ #