Monday, June 4, 2007

আল আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের নয়া ষড়যন্ত্র

ইহুদীবাদী ইসরাইল মুসলমানদের প্রথম ক্বেবলা মসজিদুল আকসার পশ্চিম দিকের প্রবেশ দ্বারে খননকাজ চালাতে গিয়ে দ্বারটি ভাঙ্গার কাজ শুরু করেছে ৷ সারাবিশ্বের মুসলমানরা ইসরাইলের এ ন্যাক্কারজনক কাজের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ৷ আল আকসা মসজিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের নয়া ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দিগন্তের আজকের আসরে রয়েছে একটি আলোচনা ৷ মসজিদুল আকসা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ধর্মীয় স্থান ৷ বিভিন্ন ধর্মের কাছে ঐতিহাসিক এ মসজিদের গুরুত্ব রয়েছে এবং ১৯৬৭ সালে ইহুদীবাদী ইসরাইল এ মসজিদ দখল করার পর থেকে এটিকে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে ৷ ইসরাইলী সেনারা কিছুদিন পরপর নতুন নতুন অজুহাতে আল-আকসা মসজিদে হামলা চালিয়ে এর ক্ষতি করছে ৷ ইহুদীবাদীরা গত ৬ই ফেব্রুয়ারি এ মসজিদের উপর সর্বশেষ আগ্রাসন চালায় ৷ এবার তারা মসজিদেরর পশ্চিম দিকের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে ৷ ইসরাইলীরা এরই মধ্যে ঐ প্রাচীরের নীচে ভূগর্ভস্থ দুটি বৃহত্‍ হলরুম ধবংস করে ফেলেছে ৷ ইসরাইল সরকার বলছে, জেরুযালেম শহরের ইহুদী অধ্যুষিত এলাকার সাথে মসজিদুল আকসার একটি সংযোগ সেতু নির্মানের লক্ষ্যে তারা ঐ ধবংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ৷ অর্থাৎ ইসরাইল মসজিদুল আকসায় ইহুদীবাদীদের যাতায়াতের সুবিধা করে দেয়ার অজুহাতে মসজিদটির একাংশ ধ্বংসের কাজে হাত দিয়েছে ৷ ইসরাইলীরা আল আকসা মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করে ১৯৬৯ সালে এটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ৷ তখন থেকে এ পর্যন্ত তেলআবিব এ মসজিদ ধবংস করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে ৷ ইহুদীবাদীরা দাবি করছে, মসজিদুল আকসার নীচে হযতর সোলায়মান (আঃ) এর উপাসনালয় অবিস্থত এবং সেটিকে খুঁজে বের করার জন্য তারা এ ধরনের ধবংসাত্মক কাজে হাত দিয়েছে ৷ তারা বিশ্বাস করে, ইহুদী জাতির মুক্তিদাতার আবির্ভাবের সময় এসে গেছে এবং তার আবির্ভাবের ক্ষেত্র সৃষ্টি করার জন্য আল আকসা মসজিদ ধবংস করে সেখানে সোলায়মানের উপাসনালয় নির্মাণ করতে হবে ৷ হযরত সোলায়মান (আঃ) প্রায় তিন হাজার বছর আগে সোলায়মানের উপাসনালয় খ্যাত স্থাপনাটি নির্মান করেছিলেন ৷ কিন্তু তার প্রায় চার শতাব্দি পর বাবোলের অধিবাসীরা এটিকে ধবংস করে ৷ তবে ঐ উপাসনালয় পুনরায় তৈরি করা হলেও হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মের ৭০ বছর পর রোম সম্রাট এটিকে ধবংস করে দেয় ৷ তবে আল আকসা মসজিদের নীচে ঐ উপাসনালয়ের অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা ব্যাপক সংশয় প্রকাশ করেছেন৷ বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইর বিন দোউফ ব্যাপক গবেষণা ও বহুবার মসজিদুল আকসা পরিদর্শনের পর ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গবেষণার ফলাফল লিখতে গিয়ে বলেন, হযরত ঈসা (আঃ) এর উপাসনালয় কোন অবস্থায়ই আল আকসা মসজিদের নীচে অবস্থিত নয় ৷ ইহুদীবাদীরা তাদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে বৈধতা দেয়ার জন্য হোলোকাস্টের মত যেসব কল্পকাহিনী তৈরি করেছে, সোলায়মানের উপাসনালয় সে রকমেরই একটি কল্পকাহিনী ৷ আরো অনেক ইতিহাসবিদ ও গবেষক মাইর বিন দোউফের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেছেন ৷ এদিকে ইহুদীবাদীরাও এতদিন ধরে খননকাজ চালানোর পরও মসজিদুল আকসার নীচে কোন ধরনের উপাসনালয় খুঁজে পায় নি ৷ কিন্তু তারপরও হযরত সোলায়মান (আঃ) এর উপাসনালয়ের সন্ধানের অজুহাতে ইহুদীবাদীরা মসজিদুল আকসা ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ৷ বলা হচ্ছে, ইসরাইলের ১২৫টি উগ্র ইহুদীবাদী গোষ্ঠি আল আকসা মসজিদকে ধবংস করার দাবি জানাচ্ছে এবং এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন কর্মসূচী দিচ্ছে ৷ এ পর্যন্ত ইহুদীবাদী সরকার মসজিদুল আকসার ভিত্তি দুর্বল করার জন্য এর নীচ দিয়ে ট্যানেল তৈরি করেছে এবং এর বেশ কিছু অংশ ধবংস করেছে ৷ ১৯৮২ সালে আল আকসা মসজিদে এ ধরনের এক আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে বহু ফিলিস্তিনী ইসরাইলী সেনাদের গুলিতে শাহাদাতবরণ করেন ৷ ১৯৯০ এর দশকে এ ঐতিহাসিক মসজিদের নীচে বহু খননকাজ চালানো হয় ৷ ১৯৯৬ সালে ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ ধরনের একটি ট্যানেল উদ্বোধন করতে গেলে ফিলিস্তিনীদের সাথে ইহুদীবাদীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায় এবং এতে বহু ফিলিস্তিনী শহীদ হন ৷ মসজিদুল আকসার পশ্চিম দিকের প্রাচীর ধ্বংসের ইসরাইলী পদক্ষেপের প্রতি মার্কিন সরকার সমর্থন জানালেও বিশ্বব্যাপী এ জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেছে ৷ কারণ, ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র স্থান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব ছাড়াও এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ৷ জাতিসংঘের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো মসজিদুল আকসা ধ্বংসের কাজ শুরু হওয়ার পর এক বিবৃতিতে বলেছে, এটি মুসলমান, ইহুদী ও খ্রীস্টানদের পবিত্র স্থান এবং এ কারণে এটি বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ৷ কাজেই ঐ স্থানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জেরুযালেম শহরের পুরনো অংশে কোন খননকাজ চালানো যাবে না ৷ কিন্তু ঐ এলাকার ফিলিস্তিনীদের বিতাড়িত করার জন্য ইহুদীবাদী সরকার তাদের উপর হামলা চালানোসহ তাদের কৃষিজমি ধবংস করে দিচ্ছে এবং সেখানে নতুন নতুন ইহুদী উপশহর নির্মাণ করছে ৷ এভাবে পূর্ব জেরুযালেমকে পুরোপুরি ইহুদীকরণ করে মসজিদুল আকসা ধবংসের কাজে হাত দেয়া তেলআবিবের লক্ষ্য ৷ এ সম্পর্কে লেবাননের আমোল আন্দোলনের নেতা শেইখ আফিফ নাবলুসি বলেছেন, ইহুদীবাদী ইসরাইল বাইতুল মোকাদ্দাস শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন শেষ করে দেয়ার লক্ষ্যে মসজিদুল আকসা ধবংসের কাজে হাত দিয়েছে ৷ তবে এ কাজে ইহুদীবাদীরা মুসলমানদের তীব্র প্রতিক্রিয়াকে ভয় পাচ্ছে ৷ কারণ, মুসলমানদের প্রথম ক্বেবলা যেখান থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উর্দ্ধাকাশে গমন করেছিলেন, তার কোন ক্ষতি মুসলমানরা হতে দেবে না ৷ ফিলিস্তিনের মুসলমানরা যখনই আল আকসা মসজিদকে বিপদের মুখে দেখেছে, তখনই তারা এ মসজিদ রক্ষার সংগ্রাম করেছে এবং ইহুদীবাদী সেনাদের হামলায় শত শত ফিলিস্তিনী শহীদ হয়েছে ৷ বর্তমানে ফিলিস্তিনীরা যে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা আন্দোলন শুরু করেছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল ২০০০ সালে এরিয়েল শ্যারনের প্রবেশের পর ৷ বর্তমানেও ফিলিস্তিনের সংগ্রামী মুসলমানরা মসজিদুল আকসা রক্ষার আন্দোলনে এগিয়ে এসেছে এবং ইহুদীবাদীদের ধবংসাত্মক কাজে বাঁধা দিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনী শহীদ হয়েছেন ৷ সিএনএন এ সম্পর্কে বলেছে, অতীতে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনীদের অধিকাংশ আন্দোলন শুরু হয়েছে মুসলমানদের প্রথম ক্বেবলা আল আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে ৷ এবারও মসজিদুল আকসার নীচে খনন কাজের সূত্র ধরে ফিলিস্তিনীদের নতুন সংগ্রাম শুরু হতে পারে ৷ নিউজ চ্যানেলটি আরো বলেছে, তারা আশঙ্কা করছে, এবার ফিলিস্তিনীরা তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরু করতে পারে ৷ মসজিদুল আকসা ধ্বংসের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ এবং বিশ্ব মুসলিমের ব্যাপক প্রতিবাদের কারণে এ ব্যাপারে মুসলিম সরকারগুলোর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে ৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিম সরকারগুলোর পক্ষ থেকে তেমন কোন প্রতিবাদের সম্ভাবনা না থাকার কারণে ইসরাইল মসজিদুল আকসা ধ্বংসের মত ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পেয়েছে ৷ কারণ, অতীতে দেখা গেছে, ইহুদীবাদী সরকার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কোন কাজ করলে মুসলিম সরকারগুলো তেলআবিবের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে ৷ কাজেই এবার মুসলিম সরকারগুলোকে এ ব্যাপারে আরো বেশী সোচ্চার হতে হবে ৷ ইহুদীবাদী সরকার যাতে আল আকসা মসজিদে আর কোন আগ্রাসন চালাতে না পারে সে লক্ষ্যে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে ৷ আর তা নিতে পারলেই ইসরাইল সরকার সম্মিলিত মুসলিম ঐক্যের কাছে মাথা নত করে এ ধরনের আগ্রাসন থেকে বিরত থাকবে ৷

No comments: