Sunday, January 22, 2012

ইরানে মার্কিন ড্রোন ও সিআইএ’র গুপ্তচর আটক : হোয়াইট হাউজের উদ্বেগ

ইরানের সেনাবাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক মার্কিন পাইলটবিহীন বিমান বা আরকিউ-১৭০ ড্রোন আটকের ঘটনা এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। মার্কিন ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে ইরানের সশস্ত্রবাহিনী সেটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাটিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ইরানের এ সফলতাকে একদিকে সাইবার যুদ্ধে মার্কিনীদের জন্য বড় আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে অন্যদিকে সাইবার প্রযুক্তিতে ইরানের দক্ষতারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। মার্কিন ড্রোন আটক নিয়ে আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র একজন গুপ্তচরকে আটকের খবর দিয়েছে। গুপ্তচর আটকের ঘটনা মার্কিন তথ্য ও গোয়েন্দা বিভাগের জন্য আরেকটি আঘাত বলে অনেকে মনে করছেন। আরকিউ-১৭০ ড্রোন : রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম! ৪ ডিসেম্বর, রোববার। আফগান সীমান্ত থেকে ইরানের প্রায় আড়াইশ' কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার পর ইরানি সেনাবাহিনীর ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার ইউনিট মার্কিন চালকবিহীন আরকিউ-১৭০ সেন্টিনাল স্টিলথ বিমানটি নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ‘বিস্ট অব কান্দাহার’ নামে পরিচিত ড্রোনটির সঙ্গে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিন অত্যাধুনিক বিমান বাহিনীর বোমারু বিমান বি-২ নকশার মিল রয়েছে। এছাড়া এফ-৩৫ জঙ্গী বিমান নির্মাণে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে সেই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে আরকিউ-১৭০ ড্রোনে। ফলে এ ড্রোনের গুরুত্ব আরো কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, আরকিউ-১৭০ ড্রোন দিনের পর দিন আকাশে ভেসে থাকতে পারে। ড্রোনটি তার উড্ডয়ন পথের বিশাল এলাকা জুড়ে সব ধরনের বেতার যোগাযোগের বিরুদ্ধে আড়ি পাততে পারে। এমনকি প্রয়োজনে ড্রোনটি তার উড্ডয়নে পথের বিশাল অঞ্চল জুড়ে সব ধরনের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা জ্যামও করে দিতে পারে। আরকিউ-১৭০ ড্রোনে যে রাডার বসানো আছে তাও অনন্য এবং অত্যাধুনিক । এ ড্রোনে বসানো আছে নানা ধরনের ক্যামেরা, লেন্স ও সেন্সর এবং এ সবের সাহায্যে অনন্য ছবি তুলতে পারে ড্রোনটি। কিন্ত এতো কিছুর পরও ইরান ড্রোনটিকে ভূপাতিত ধারণা করা হচ্ছে- ইরানিরা ড্রোনটির নেভিগেশন সিস্টেম হ্যাক করেছিল, আর তাতেই এটি নিরাপদে মাটিতে নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ড্রোনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ইরানের মাটিতে নামিয়ে আনার ঘটনা তেহরানের জন্য বিশাল সাফল্য এবং ওয়াশিংটনের জন্য বড় ধরনের আঘাত বলে মনে করা হলেও মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানকে কোন কৃতিত্ব দিতে নারাজ। তারা দাবি করেছেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাদের ড্রোন ইরানে ভূপাতিত হয়েছে। এ দাবির মাধ্যমে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান। একদিকে দেখাতে চান, তারা ইচ্ছে করে ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেননি এবং অন্যদিকে ইলেকট্রনিক যুদ্ধে ইরানের সক্ষমতাকে উপেক্ষা করতে চান তারা। ড্রোন ফেরত চেয়েছেন ওবামা, ইরানের ‘না’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অবশেষে স্বীকার করেছেন যে, ইরান তাঁর দেশের একটি চালকবিহীন বিমান আটক করেছে। ওয়াশিংটনে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন চলাকালে ওবামা ওই ড্রোনটি ফেরত চান। তিনি বলেন, ‘এর পর ইরান কি আচরণ করবে সেটি যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণ করবে।’ তবে ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির প্রধান আলাউদ্দিন বুরুজারদি বলেছেন, ভূপাতিত মার্কিন ড্রোন ফেরত দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরো বলেছেন, ‘ইরানের আকাশসীমা লংঘনের জন্য বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’ ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রমিন মেহমানপারাস্ত বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানে ভূপাতিত হওয়া ড্রোন ফেরত চেয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিতান্তই তাদের মুখ বাঁচানোর কৌশল। তিনি আরো বলেছেন, ইরানের আকাশসীমা লংঘন করার অপরাধে মার্কিন সরকার ক্ষমা না চেয়ে বরং তারা উল্টো অসৎ কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। মেহমানপারাস্ত আরো বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে হয় ভুলে গেছেন যে, তাদের গোয়েন্দা বিমান ইরানের আকাশসীমা লংঘন করে গুপ্তরচরবৃত্তির কাজ করছিল। এ ছাড়া, মার্কিন প্রশাসন ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে হস্তক্ষেপ করে আসছে। এ সবই আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লংঘন বলে মন্তব্য করেন রমিন মেহমানপারাস্ত। অন্যদিকে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ ওয়াহিদি বলেছেন, ভূপাতিত হওয়া মার্কিন ড্রোন এখন ইরানের সম্পদ। তিনি জানিয়েছেন, এ ড্রোন এখন নিজস্ব সম্পদ হিসেবেই ইরানে থাকবে এবং ইরানি জাতিই ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আরকিউ-১৭০ বিমানের উন্নত সংস্করণ তৈরি করবে ইরান যুক্তরাষ্ট্র যে ড্রোনটিকে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম বলে দাবি করেছিল, সেটি ইরানের হস্তগত হওয়ায় মার্কিন সরকারের রাডার ফাঁকি দেয়ার সব কলাকৌশল এখন ইরানের আয়ত্বে চলে এসেছে। ইরান ঘোষণা করেছে, আরকিউ-১৭০ বিমানের উন্নত সংস্করণ তৈরি করবে তেহরান। আরকিউ-১৭০ খতিয়ে দেখে তারচেয়েও উন্নত মানের ড্রোন তৈরির ক্ষমতা যে ইরানের আছে, তা স্বীকার করেছেন মার্কিন দৈনিক 'ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরের' সাংবাদিক পিটার গ্রিরিয়ার। তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এর আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে নিম্ন অবস্থানে রয়েছে এমন একটি দেশ মার্কিন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অনুকরণ করতে পেরেছিল। তিনি জানান, ১৯৪৭ সালের আগস্টে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন 'তু -৪ বুল'নামের বিমান প্রদর্শন করে। এ বিমানটি মার্কিন বোমারু বিমান বি-২৯-এর অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল। এর আগে অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ঘাঁটিতে বি-২৯ বিমান জরুরী অবতরণে বাধ্য করেছিল তৎকালীন সোভিয়েত সরকার।‘ হোয়াইট হাউজের বিস্ময় ও শংকা ইরানের সেনাবাহিনীর ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ ইউনিট মার্কিন অত্যাধুনিক পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন ইরানের মাটিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা হতভম্ভ ও বিস্মিত হয়েছেন। মার্কিন কর্মকর্তারা প্রথম দিকে মার্কিন ড্র্রোন ইরানের হস্তগত হওয়ার ব্যাপারে নানা সন্দেহ ও সম্ভাবনার কথা বললেও ইরান বিষয়টিকে গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরার পর মার্কিন কর্মকর্তাদের কথাবার্তায়ও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে । মার্কিন দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এর আগে খবর দিয়েছিল, আরকিউ-১৭০ ড্রোন ইরানীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার অথবা তা ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু ইরানি সেনাবাহিনী পাল্টা আঘাত হানতে পারে এ আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের সে চিন্তা থেকে সরে আসে। ওয়াশিংটনের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো- ড্রোনটি আটক হওয়ার পর রাশিয়া ও চীন তা পরিদর্শনের অনুমতি চেয়েছে ইরানের কাছে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ কুইন্টানা এ বিষয়ে বলেছেন, রাশিয়া ও চীনকে ইরান ড্রোনটি দেখতে দিলে তারা অত্যাধুনিক বিমানটি নকল করবে। তারা এ ড্রোনের রাডার ফাঁকি দেয়ার বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে স্টিলথ প্রযুক্তির পঞ্চম প্রজন্মের জঙ্গী বিমান অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। চীন ও রাশিয়া এ প্রযুক্তি সংগ্রাহের জন্য মুখিয়ে রয়েছে। কুইন্টানা বলেন, মার্কিন প্রযুক্তি অনুকরণের জন্য চীন খুবই আগ্রহী। চীন ও রাশিয়া ড্রোনের সেন্সর পর্যবেক্ষণ করতেও খুব আগ্রহী। এ সেন্সরের মাধ্যমে ড্রোনটি বিশাল এলাকার ওপর নজর রাখতে সক্ষম। এছাড়া রাডার ফাঁকি দিতে ও মাটি থেকে ৫০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়তে সক্ষম। মার্কিন নৌবাহিনীর পি-৩ ওরিয়ন ২০০১ সালে চীনের হস্তগত হয়। এর ফলে চীন গোয়েন্দা ব্যবস্থার পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র তার পুরো নৌবহরকে আরও উন্নত করতে বাধ্য হয়। কুইন্টানা বলেন, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান মার্কিন ড্রোন নামিয়ে আনায় একদিকে যেমন ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধে তাদের দক্ষতার প্রমাণ মিলেছে অন্যদিকে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম বলে পরিচিত অত্যাধুনিক এ ড্রোন এখন ইরানী বিশেষজ্ঞদের নাগালে চলে এসেছে। এটি ইসরাইল ও মার্কিনীদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর একটি ঘটনা। ড্রোনের পর সিআইএ’র গুপ্তচর আটক ইরানে মার্কিন ড্রোন ভুপাতিত হওয়া নিয়ে মিডিয়ায় যখন তোলপাড় চলছে ঠিক তখন (১৭ ডিসেম্বর) ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী সিআইএ’র একজন গুপ্তচরকে আটক করার দাবি করেছে। ১৮ ডিসেম্বর সিআইএ'র গুপ্তচর আমির মির্জা হেকমাতি ইরানের টেলিভিশনে প্রচারিত এক স্বীকারোক্তিতে আমির মির্জা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় তার বাড়ি এবং ২০০১ সালে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর এক দশক ধরে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় বাগরাম বিমান ঘাঁটিতেও তিনি কাজ করেছেন। এছাড়া তেহরানে আসার আগে তাকে মার্কিন গোয়েন্দারা বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন। স্বীকারোক্তিতে আমির মির্জা জানিয়েছেন, প্রথমে তিনি কিছু তথ্য দিয়ে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের আস্থা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। এ মিশন সফল হলে তাকে সিআইএ আরো বড় মিশনের পাঠানোর কথা বলেছিল। এ জন্য তাকে বিপুল অংকের অর্থও দিতে চেয়েছিল সিআইএ। আমির মির্জা ইরানে গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়ে তার অপরাধ স্বীকার করেছে। তবে তার মিশন শুরু হওয়ার আগেই এই মার্কিন গুপ্তচর ইরানের গোয়েন্দা সেনাদের হাতে আটক হয়। সিআইএ'র ওই চর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আফগানিস্তানের বাগরাম সেনাঘাঁটিতে পৌঁছার পর থেকেই তাকে অনুসরণ করছিল ইরানের গোয়েন্দা সেনারা। পরবর্তীতে ইরানের ভূমিতে প্রবেশ করার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। গুপ্তচরকে ফেরত চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে আটক মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-সিআইএ'র একজন গুপ্তচরকে অবিলম্বে ফেরত দেয়ার আহবান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড হেকমাতিকে মুক্তি দেয়ার আহবান জানিয়ে বলেছেন,যুক্তরাষ্ট্র তেহরানে নিযুক্ত সুইস দূতাবাসের মাধ্যমে হেকমাতির সঙ্গে সাক্ষাত করতে সুযোগ দেয়ার জন্য ইরানের কাছে আবেদন জানিয়েছে। নুল্যান্ড দাবি করেছেন, ইরানে আটক মার্কিন গুপ্তচর হেকমাতির পরিবার গত সেপ্টেম্বরে তার আটকের খবর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানিয়েছে। তিনি আরো দাবি করেছেন, হেকমাতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিযোয়ানা অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর মার্কিন মেরিন বাহিনীতে যোগ দেন। ‘সিআইএ'র শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ভেঙ্গে দিয়েছে ইরান' ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির সদস্য হাসান কামরান বলেছেন, মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-সিআইএ'র গুপ্তচর আটকের মাধ্যমে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গোয়েন্দা শক্তি প্রমাণিত হয়েছে। তিনি সিআইএ'র এ গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনাকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। হাসান কামরান আরো বলেন, ‘এ ঘটনার আগে শত্রুরা কখনই চিন্তা করেনি যে, তাদের গুপ্তচরেরা ইরানের গোয়েন্দাদের হাত ধরা পড়তে পারে।’ ইরানে এর আগেও সিআইএ'র গুপ্তচর আটক করা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে সিআইএ'র গুপ্তচর ও সন্ত্রাসী চক্রের ৩০ সদস্যকে আটক করা হয়। গত ২৪ নভেম্বর আরো ১২ জন সিআইএ এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়। তারা ইরানের পরমাণু স্থাপনাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নাশকতামূলক তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। তবে ইরানের হাতে মার্কিন গোয়েন্দা বিমান আরকিউ-১৭০ ভূপাতিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইহুদিবাদী ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই -সিক্সকে একসঙ্গে ইরান বিরোধী তৎপরতার জন্য নতুন কর্মসূচি গ্রহণে মার্কিন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য তিনি আলাদা বাজেটও দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দেশের আকাশসীমা লংঘন করা এবং গুপ্তচর পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির আলোকে সমর্থনযোগ্য কিনা। এ বিষয়ে জাতিসংঘ সনদের চার নম্বর অনুচ্ছেদের দু'নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, "কোন দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি বা বলপ্রয়োগ নিন্দনীয়। ১৯৭৪ সালে এ ধারায় আনা এক সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কোন দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনকে ওই দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। " রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর জন্যই সিআইএ ইচ্ছাকৃতভাবে ইরানে ড্রোন ও গুপ্তচর পাঠিয়েছিল। কাজেই আন্তর্জাতিক আইনে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মাদ খাযায়ি এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মার্কিন ড্রোন কর্তৃক ইরানের আকাশসীমা লংঘনের ব্যাপারে নিন্দা প্রস্তাব পাশ করতে হবে। হুমকি পাল্টা হুমকি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) একপেশে রিপোর্ট, ইরানে 'স্টুক্সনেট' ভাইরাসের মত সাইবার হামলা, ইরানের কয়েকজন বিজ্ঞানীকে হত্যা, ওয়াশিংটনে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হত্যার কথিত পরিকল্পনা, তেহরানস্থ ব্রিটিশ দূতাবাসে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হামলা, ব্রিটেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ এবং মার্কিন ড্রোন ও সিআইএ’র গুপ্তচর আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হুমকি-পাল্টা হুমকি অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন 'দ্য আর্লি শো' নামের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'ইরানকে একঘরে করার জন্য বিশ্বকে একতাবদ্ধ করা জরুরি হয়ে উঠেছে এবং এ ভাবেই কেবল কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে।' ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগও ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, উইলিয়াম হেগ বলেছেন, ব্রিটিশ সরকার দীর্ঘমেয়াদে ইরানের ওপর সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না। অন্যদিকে ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ বলেছেন, ইরানের ওপর হামলার সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুদ্ধমন্ত্রী ইহুদ বারাকও একই রকমের হুমকি দিয়েছেন। তবে এসব হুমকির বিরুদ্ধে ইরানী কর্মকর্তারাও পাল্টা হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আহমাদ ওয়াহিদি বলেছেন, ইরান আক্রান্ত হলে ইসরাইলকে ভালো মতো শিক্ষা দেয়া হবে। তিনি আরো বলেছেন, ইরানের ওপর সামরিক হামলা হলে ইসরাইলের টিকে থাকার সামান্যতম সম্ভাবনা নেই। ইসরাইলের সব জায়গায় ইরান হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র মারবে। ইরানের দেড় লাখ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের জন্য অপেক্ষা করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। তবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানে হামলা চালানোর যে হুমকি দিচ্ছে তা তেহরানের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াদুল্লাহ জাভানি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল যদি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে তাহলে ইসরাইলের প্রতি ইঞ্চি ভূমি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। এ হামলা থেকে ইসরাইলের পরমাণু স্থাপনাও বাদ যাবে না। ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে তিনি আরো বলেছেন, "ইরান শুধু শত্রুদের হামলা প্রতিহতই করবে না বরং শত্রুর ভূখণ্ডেও ধ্বংসাত্মক পাল্টা হামলা চালাবে।" ‘ইসরাইল-আমেরিকার পিছটান’ এতদিন ইরানের বিরুদ্ধে হামলার হুমকি দিলেও ইসরাইল, আমেরিকা ও তাদের মিত্ররা পিছু হঠেছে। ইসরাইলের সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী শাঁওল মোফায বলেছেন, ইরানে হামলা করার সিদ্ধান্ত হবে মস্ত বড়ো ভুল। ইসরাইলী যুদ্ধমন্ত্রী ইহুদ বারাকও তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বলেছেন, ইসরাইল ইরানে হামলা করবে না। এর আগে ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রোদি বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন ও ইহুদবাদি ইসরাইলের হুমকি কোনো ফল বয়ে আনবে না। এদিকে চীনের প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজর জেনারেল ঝাং ঝাওঝোং বলেছেন, ইরানের ওপর কোনো হামলা হলে চীন সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে দ্বিধা করবে না এবং এ জন্য যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধেও যায় তার পরোয়া করবে না বেইজিং। তিনি বলেন, ইরান রক্ষায় এগিয়ে আসতে চীন কোনো দ্বিধাই করবে না। তিনি বলেন, ইরান শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির আড়ালে বোমা বানানোর চেষ্টা করতে পারে বলে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী ইসরাইল মাঝে মধ্যেই তেহরানের বিরুদ্ধে হামলার হুমকি দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের যে মিডিয়া যুদ্ধ চলছে, তাতে ঝাং ঝাওঝোং এই মন্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করল । বিশ্লেষকদের মতে ঝাং ঝাওঝোং এই মন্তব্য পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এক সতর্ক বার্তা। আর এজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখানো থেকে বিরত রয়েছে। #