Sunday, September 5, 2010

বাংলা কবিতা ও গানে ঈদ উৎসব

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ। প্রতি বছর ঈদকে সামনে রেখে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দেখা যায় নানা আয়োজন। প্রবন্ধ, গান, ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান কোন কিছুই বাদ যায় না। ঈদকে কেন্দ্র করে কবি- সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, অভিনেতাদের ব্যস্ত সময় কাটে। সত্যি বলতে কী, এমন কোন মুসলিম কবি-সাহিত্যিক কিংবা লেখককে হয়তো পাওয়া যাবে না যিনি ঈদ নিয়ে কোন লেখা লিখেননি। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষী কবি-সাহিত্যিকরাও পিছিয়ে নেই। যতটুকু জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতাটিই সম্ভবত বাংলাভাষায় রচিত প্রথম ঈদ-বিষয়ক কবিতা। ১৯০৩ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নবনূর পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় কবিতাটি ছাপা হয়। তিনি লিখেছেন-
“ ধর্ম ও কর্মরে জীবনের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করি আজ জীবনের আবহে হও অগ্রসর, নাহি তাতে কোন লাজ। যে চেতনা থাকে একদিন জাগি, দীর্ঘ নিদ্রা তার পরে, সে তো আনে শুধু ঘন অবসাদ জীবনে ঢালে অনন্ত বিষাদ দেও তারে দূর করে। ”
মানবজাতির তথা মুসলমানদের মহামিলনের উৎসব ঈদকে নিয়ে কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি এ রকম-
“ এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ, বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান। এ ত নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা। এ শুধু জাতীয় পুণ্যমিলনের এক মহামেলা। ”
কবি কায়কোবাদ ঈদকে পুণ্যমিলনের মহামেলা হিসেবে অভিহিত করলেও ইসলামের নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ না করার কারণে ঈদের দিনেও গরিব-দুঃখী ও অসহায়দের কষ্টের যেন শেষ থাকে না। এ দিকটি ফুটে ওঠেছে শাহাদাত হোসেনের ‘বাংলার ঈদ’ কবিতায়। কবি লিখেছেন,
“ বাংলার মুসলমান শুধু চেয়ে রয়- মৌন ম্লান ক্লিষ্ট মুখ নির্বাক নিশ্চল। ফিত্রার খুশী কোথা তার? কি দান সে দিবে ক্ষুধিতেরে? নিজেই কাঙাল রিক্ত- ভিক্ষা মাগি ফিরে দ্বারে দ্বারে।”
এ কবিতায় কবি ফিতরা আদায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ঠিকমত ফিতরা ও যাকাত দেয়া গেলে অসহায়, দরিদ্ররাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। সমাজে নেমে আসবে শান্তি-সুখের ফল্গুধারা। এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেই সম্ভবত কবি গোলাম মোস্তফা ঈদকে মানবতার বিরাট প্লাটফর্ম হিসেবে কল্পনা করেছেন। ঈদ উৎসব কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“ কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী, বক্ষে ভরা তার শান্তি, চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতি ভার, বিশ্ব-বিমোহন কান্তি প্রীতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগ-বেদনার শ্রান্তি।”
ঈদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা ও গান লিখেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখা -
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ।’
-এ গানটি ছাড়া ঈদের আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। এছাড়া, ‘ঈদ মোবারক’ ও ‘কৃষকের ঈদ’ ও ‘ঈদের চাঁদ’ কবি নজরুলের বহুল আলোচিত কবিতা। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় কবি লিখেছেন,
“শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো, কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো, বরষের পরে আনিলে ঈদ! ”
এ কবিতায় নজরুল দেখেছেন অসংখ্য মরুভূমি,বালুচর আর অনাবিল আঁখিজল পেরিয়ে এসেছে ঈদ। তিনি বলতে চেয়েছেন,মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সুখ-দুঃখের সমভাগী হয়ে অধিকার ভোগ আর দায়িত্ব পালনের মধ্যে যে প্রকৃত আনন্দ,সে শিক্ষা যেন রয়েছে ঈদের মাহাত্ম্যে। ঈদের মহান শিক্ষাই হচ্ছে সব ভেদাভেদ-হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঈদের জামায়াতে দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা । কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ঈদ সচরাচর দেখা যায় না। এ দিনও দেখা যায় গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা শীর্ণ গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায় জমিতে লাঙল দিতে। এদিকে ইঙ্গিত করে তিনি রচনা করেছেন তার কৃষকের ঈদ কবিতাটি। কবির ভাষায়-
“জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিদ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ? একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পুঁজরের হাড়?”
কবি নজরুলের কবিতা ও গানে ঈদের তাৎপর্য্য, এ দিনের করণীয় ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ পুরো দুনিয়াকে ঈদগাহ্‌র সাথে তুলনা করেছেন । ‘ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
আজকে এল খুশীর দিন দেখ না চেয়ে খুশীর চিন দেখ না চেয়ে আজ রঙিন খুশীর ঝলক ঈদগাহে। ................................ জামাত ছেড়ে থাকবে যে ঘরের কোণে রইবে সে রইবে হয়ে একপেশে একলা থাকায় দুঃখ তাই। সবাই মিলে একদলে এক আশাতে যাই চলে এক আশাতে যাই বলে ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই।
শাওয়ালের রূপোলী চাঁদ পশ্চিমাকাশে মুচকি হেঁসে জানিয়ে দেয় যে, ঈদ এসেছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এ দিন নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন-
“চাঁদ উঠিয়াছে, ঈদের চাঁদ কি উঠেছে? শুধায় সবে। লাখো জনতার আঁখি থির আজি সুদূর সুনীল নভে। এই ওঠে,ওই উদিল গগনে সুন্দর শিশু চাঁদ— আমিন। আমিন। রাব্বুল আলামিন করে সবে মোনাজাত।”
আগেই বলেছি, ঈদের নতুন চাঁদ সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। এদিন গরীব-দুঃখী ও অসহায়দের মনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে কবি তালিম হোসেনের ‘ঈদের ফরিয়াদ’ কবিতায়। কবির ভাষায়-
‘ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খোশরোজে দাওয়াত কবুল কর মানুষের বেদনার মহাভোজে। কহিব কি আর, চির-মানুষের ওগো বেদনার সাথী, ঈদের এ দিন শেষ হয়ে আসে, সমুখে ঘনায় রাতি।’
কবি সিকান্দার আবু জাফর প্রায় একই বিষয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। ঈদ উপলক্ষে দোয়া চেয়ে পিতার কাছে লেখা ‘ঈদের চিঠি’-তে তিনি লিখেছেন-
“ঈদের সালাম নিও,দোয়া করো আগামী বছর কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা। অন্ততঃ ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি, একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি তোমাকে পাঠাতে যেন পারি; আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা।”
অন্যদিকে সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চাঁদের হাসিতে দেখতে পেয়েছেন নতুন দিনের বারতা। লিখেছেন-
“এসেছে নূতন দিন আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ। জরির জোব্বা, শেরোয়ানী আর আমামার সজ্জায় আতরের পানি, মেশেকর রেণু খোশবু বিলায়ে যায়— বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে, রাত্রি হয়েছে ভোর।” (এসেছে নূতন দিন)
সমাজে ঈদের খুশীর প্রভাব সম্পর্কে কবি আ.ন.ম বজলুর রশিদ তার 'ঈদ আসে' কবিতায় লিখেছেন-
ঈদ আসে হাসি-খুশী তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে অনেক আনন্দ নিয়ে কিছুক্ষণ ভুলে যাই দুঃখ জ্বালা যত আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ হয়ে থাকা অবিরত আল্লাহর প্রশংসায় গান, তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে।
কবি তফাজ্জল হোসেন খান ঈদ নিয়ে চমৎকার একটি গান লিখেছেন । প্রতি বছর ঈদ এলেই শিশুরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে এ গানটি।
“আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে দুলছে খুশীর নদী প্লাবনে ঘরে ঘরে জনে জনে আজি মুখর হব মোরা গানে গানে ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক আজ বল ঈদ মোবারক আজ।”
অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক ঈদের দিনকে খুশীর দিন হিসেবে চিত্রিত করলেও কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার গানে লিখেছেন,
“ঈদের খুশী অপূর্ণ রয়ে যাবে ততদিন খোদার হুকুমাত হবে না কায়েম কায়েম হবে না যতদিন।”
কবির এ গানের কথাগুলো যৌক্তিক। কারণ দুনিয়ায় খোদার হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। আর এ বৈষম্য দূর হলেই ঈদ হবে সত্যিকার আনন্দের দিন; তা সবার হৃদয়ে বুলিয়ে দেবে প্রেম প্রীতি আর শান্তির পরশ। এছাড়া ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সারাবছর নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারলেই ঈদ উৎসব সার্থক হবে। ঈদের দিন যেভাবে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে যায়,সারাবছর ধরে সেই বিভেদের দেয়ালকে তুলে ফেলতে হবে। কবি গোলাম মোস্তফার কথায়-
“আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে, আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে, এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য নিখিল-মানবের মিলন জন্য, শুভ যা জেগে থাক,অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।”