Tuesday, April 21, 2009
পশ্চিমা সমাজে নৈতিক অধঃপতনের বিস্তার
পাশ্চাত্যে যৌন অনাচার ও নৈতিক অধঃপতনের বিস্তারে সমাজ-বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তালাকের হার বৃদ্ধি, পরিবার ব্যবস্থায় ধ্বস, লিভ টুগেদার বা অবৈধভাবে স্বামী-স্ত্রীর মত জীবন যাপন, ব্যাভিচার এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে অশ্লীলতার মত সংকটের বিস্তারে পাশ্চাত্যের সরকারী পরিকল্পনাবিদরাও শঙ্কিত। পাশ্চাত্যে নৈতিক অধঃপতন এতটা মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে যে সেখানে অযাচার বা পরিবারের যেসব সদস্যের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের সাথেও ব্যাভিচারের ঘটনা বাড়ছে।
কয়েক মাস আগে অস্ট্রিয়ায় এ ধরনের একটি ঘটনা ফাঁস হয়েছে। দেশটিতে জোসেফ ফ্রিটজেল নামের ৭২ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি নিজের কন্যাকে বিগত ২৪ বছর ধরে একটি ভূগর্ভস্থ স্যাতস্যাতে কক্ষে আটক করে রেখেছিল। শুধু তাই নয় এই নির্দয় পিতা নিজ কন্যার শ্লীলতাহানি করে সাতটি সন্তানের জনক হয়েছে। সম্প্রতি বৃটেন ও ইতালীতেও এ ধরনের ঘটনা ফাঁস হয়েছে। ইতালীতে এক পিতা তার কয়েক জন কন্যার সম্ভ্রমহানি করেছেন, এমনকি নিজের এক পুত্র সন্তানকেও এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে অংশ নিতে উৎসাহ দিয়েছেন। কলম্বিয়াতেও এক নরপশু তার এক কন্যাকে নয় বছর বয়স থেকে দীর্ঘ ২১ বছর পর্যন্ত পাশবিকতার শিকারে পরিণত করে ১১ টি সন্তানের জন্ম দিয়েছে । এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, পাশ্চাত্যের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জীবন-ব্যবস্থাও এখন হুমকির মুখে।
পাশ্চাত্যে নৈতিকতার অবক্ষয় এবং আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাবার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যেই সূচিত হয় রেনেসাঁর যুগে। ঐ যুগে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদরা গীর্যার কর্তৃত্ব খর্ব করার পাশাপাশি ধর্মকেও কোনঠাসা বা একঘরে করে। ফলে পাশ্চাত্যে ধীরে ধীরে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ এবং এ সংক্রান্ত সীমারেখাগুলো পদদলিত হতে থাকে। ১৯৬০'র দশকে পাশ্চাত্যে নগ্নতা, অশ্লীলতা ও যৌণ-অনাচার ব্যাপকতা লাভ করে। এর আগে নৈতিকতার সীমানাগুলো সমাজের নৈতিক ও মানসিক সুস্থতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপনে নগ্নতা ও অশ্লীলতার প্রচারের ফলে এইসব সীমারেখা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের প্রসারের পাশাপাশি বিস্তার ঘটে স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসঘাতকতা, তালাক, বিবাহ ছাড়াই স্বামী-স্ত্রীর মত একসাথে জীবন যাপন ও সমকামিতার মত জঘন্য পাপাচার। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয়ের ঐ জোয়ারের সময়ই অনেক চিন্তাবিদ যৌন অনাচার ও লাগামহীনতার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। ষাটের দশকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী নৈতিক অবক্ষয়ের এই সংকটের কথা স্বীকার করে বলেছিলেন," ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুব-প্রজন্ম আরামপ্রিয় ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। এরা যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়-চিত্ত নয়। এদের প্রতি সাত জনের মধ্যে ছয় জনই অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়-বিলাসিতার কারণে শারীরীক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আমি আগামী প্রজন্মের মার্কিনীদের জন্য গভীরভাবে শঙ্কিত।"
অবশ্য কেনেডীর ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়েও মার্কিন সমাজের পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বই-পুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটসহ সমস্ত গণমাধ্যম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লাগামহীন যৌণাচার বা ব্যাভিচারের প্রচার-প্রসারের কাজে নিয়োজিত। এইসব গণমাধ্যম পারিবারিক বন্ধন ও স্বামী-স্ত্রীর বৈধ ভালবাসার সম্পর্ককে ধ্বংসের কাজে এতটা সফল হয়েছে যে এসব মূল্যবোধ কেবল বদলে গেছে তা নয়, বরং পুরোপুরি উল্টে গেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ফরাসী চিন্তাবিদ ডক্টর এ্যালেক্সিস কার্ল লিখেছেন, আমরা সমস্ত ঘরোয়া মূল্যবোধকে ধর্মীয় বিধানের মতই নির্মূল করেছি। আজকের নতুন প্রজন্ম অতীতের ঐসব মূল্যবোধ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। সংযম, চারিত্রিক পবিত্রতা বা সততা, বন্ধুত্ব, দায়িত্বশীলতা, আত্মশুদ্ধি বা আত্মিক পবিত্রতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা, চারিত্রিক বা নৈতিক মহত্ত্ব -- এ সবই এখন অর্থহীন শব্দ মাত্র এবং আজকের যুব সমাজের কাছে পরিহাসের বিষয়।
ইরানী লেখক মাহমুদ হাকিমী "অসুস্থ পশ্চিমা সমাজ " শীর্ষক বইয়ে একটি মার্কিন ম্যাগাজিনের উদ্বৃতি দিয়ে লিখেছেন, শয়তানের তিন ধরনের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের বিশ্বটাকে ঘেরাও করেছে। প্রথমতঃ অশ্লীল সাহিত্য এবং পর্দাহীনতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর্দাহীনতা অত্যন্ত বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রচলন অব্যাহত থাকে। এই লজ্জাহীনতা বা বেহায়াপনা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ চলচ্চিত্র বা ছায়াছবিগুলো মানুষের মধ্যে অশালীনতা ও ইন্দ্রিয়পরায়নতা বৃদ্ধি করেছে এবং এ ধরনের অনৈতিক আচরণের বাস্তব পথ বা পন্থাও শিখিয়ে দিচ্ছে। তৃতীয়তঃ সাধারণ মহিলাদের মধ্যে পোশাক পরার ক্ষেত্রে কুরূচি বা অশ্লীলতা ও এমনকি নগ্ন হওয়া এবং পুরুষদের সাথে অবাধ মেলা-মেশার প্রচলন।
পাশ্চাত্যে মহিলাদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের উস্কানী। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণরা শৈশব থেকে কৈশর পর্যন্ত কেবল টেলিভিশনের পর্দায় সম্ভ্রমহানির কয়েক হাজার দৃশ্য দেখে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে বহু মহিলা কর্মস্থলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পথে-ঘাটে সম্ভ্রমহানির শিকার হন। দেশটির শতকরা ২০ ভাগ মহিলা নিজ বন্ধুদের পাশবিক হামলার শিকার হন। এ ধরনের মার্কিন নারীদের মধ্যে শতকরা ৬১ জনের বয়স ১৮ বছরেরও কম এবং শতকরা ২৯ জনের বয়স ১১ বছরেরও কম। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮ থেকে ১৯ বছর বয়স্ক ২১০ নারীর সম্ভ্রমহানির দায়ে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এ ধরণের ভয়াবহ খবর মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৭ সালে বৃটেনের ১৫ বছর বয়সী ৫০ হাজার কিশোরী গর্ভপাত ঘটানোর জন্য চিকিৎসালয়ে ধর্ণা দিয়েছে। পাশ্চাত্যে ধর্ষণের শিকার অনেক মহিলাই পুলিশের কাছে সম্ভ্রমহানির কথা জানান না। অনেক নারী চিরজীবন এ দুঃখ মনের মধ্যেই গোপন রাখেন। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ দেশগুলোতেও নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে।
বৃটেনে প্রতি ৫ জন মহিলা পুলিশের মধ্যে চার জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের সময় যৌণ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বিখ্যাত মার্কিন লেখক অধ্যাপক উইলিয়াম মার্কিসন লিখেছেন, স্বামী-স্ত্রীর সুশৃঙ্খল বা সুস্থ যৌন সম্পর্ক বাদ দিয়ে আমরা প্রাণঘাতি এইডস ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের শিকার হয়েছি। আমরা বিয়ের সম্পর্ক ত্যাগ করে তালাককে উন্নত জীবন হিসেবে বেছে নিয়েছি। গর্ভপাতকে অপরাধ মনে না করে এ কাজকে এখন আমরা মানবাধিকার বলে মনে করছি এবং এ কাজকে ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতার গৌরবময় লক্ষণ বলে ধরে নিয়েছি।
এভাবে পশ্চিমা সমাজে নৈতিক অধঃপতন ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা সভ্যতার অগ্রগতি এবং সেখানকার আরাম-আয়েশের জীবন খুব ভালোভাবে তুলে ধরলেও সেখানকার নৈতিক অবক্ষয়ের কথা তৃতীয় বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই এড়িয়ে যান, বা সে বিষয়কে গুরুত্ব দেন না। বরং তারা নিজ দেশেও সবক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের জন্য প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটও যুক্ত হওয়ায় পশ্চিমা সভ্যতার পতন আরো এগিয়ে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় সাবেক কংগ্রেস সদস্য বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের দাবী থেকে দেশটির নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বলেছেন,
" হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে হবে। কিন্তু যে দেশটিতে ১২ বছরের বালিকারা গর্ভ ধারণ করে, ১৫ বছর বয়স্করা একে-অপরকে হত্যা করে, ১৭ বছর বয়স্করা এইডস রোগে আক্রান্ত হয় এবং ১৮ বছর বয়স্করা ডিপ্লোমা লাভ করা সত্ত্বেও লিখতে ও পড়তে পারে না, তারা কারোরই নেতৃত্ব দিতে সক্ষম নয়। "
Subscribe to:
Posts (Atom)