Tuesday, March 3, 2009

পাশ্চাত্যে পারিবারিক কাঠামো ধ্বংসের প্রচেষ্টা

পশ্চিমা চিন্তাবিদগণ বহুদিন যাবত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কিছু সংকটের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন যেগুলোর অধিকাংশই নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমা সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে, সেখানে পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। লিবারেলিযম বা কথিত উদার নৈতিকতার নামে এমন সময় পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, যখন সমাজের অন্যতম ভিত্তিই হচ্ছে পরিবার। অবস্থা এমন উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে যে, কোন কোন পশ্চিমা চিন্তাবিদ এর কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বই লিখে ফেলেছেন। The War Against The Family 'দ্যা ওয়ার এ্যাগেইনস্ট দ্যা ফ্যামিলি' বা 'পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নামের বইটিতে পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কানাডার চিন্তাবিদ উইলিয়াম গার্ডনার (William Gairdner) এ বইয়ের লেখক। এ বইটি শুরু করা হয়েছে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ফিশার এইমসের (Fisher Ames) একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়ে। এতে বলা হয়েছে, "আমরা এখন গণতন্ত্র নামের এমন একটি চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি যেখানে নাগরিকদের স্বাধীনতাকে হত্যা করার আগে তাদের চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।" ঊনবিংশ শতাব্দির মার্কিন লেখকের এই উদ্ধৃতিটি প্রমাণ করে, গণতন্ত্র- কথিত স্বাধীনতার নামে যে পশ্চিমা জনগণের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিয়েছে তাই নয়, সেই সাথে তাদের চরিত্র নষ্ট করার পাশাপাশি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। উইলিয়াম গার্ডনার তার বইয়ের শুরুতে পরিবার সম্পর্কে বলেছেন, "পিতা, মাতা ও সন্তানের সমন্বয়ে যে পারিবারিক কাঠামো গঠিত হয়েছে তার রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য। পারিবারিক কাঠামোকে কী পরিমাণ অবহেলা করা হচ্ছে তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ এ পর্যন্ত মানবাধিকার, নারী অধিকার ও শিশু অধিকারসহ আরো বহু অধিকার আদায় করার জন্য আইন প্রণয়নসহ আরো বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পারিবারিক অধিকার রক্ষা বা পারিবারিক কাঠামো রক্ষার কথা কাউকে বলতে শোনা যায় নি। 'পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শীর্ষক বইয়ে পরিবার ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের জন্য পশ্চিমা সরকারগুলোকে দায়ী করা হয়েছে। গার্ডনার মনে করেন, পশ্চিমা সরকারগুলো চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপের দিক দিয়ে সাবেক কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোর পর্যায়ে চলে গেছে। সুদূর অতীতকাল থেকে সমকামীতা একটি চরম জঘন্য ও ঘৃনিত বিষয় বলে বিবেচিত হয়ে আসলেও বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে এ বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সমকামীদের কথিত অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। অনেক পশ্চিমা দেশে সমকামীদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে এবং গর্ভপাতকেও বৈধতা দেয়া হচ্ছে। গার্ডনার তার বইয়ে এক্ষেত্রে বৃটিশ লেখক এ্যালডাস হ্যাক্সলির (Aldus Haxly) একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন। হ্যাক্সলি বলেছেন, "পশ্চিমা দেশগুলোতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকার কারণে যে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়ার জন্য অবাধ যৌন স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।" অর্থাৎ পশ্চিমারা নিজেদেরকে স্বাধীনতার প্রবক্তা বলে দাবি করলেও তারা যে তাদের জনগণকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিতে পারে নি, সেকথা পশ্চিমা ঐ লেখকের কথায় ফুটে উঠেছে। গার্ডনার এ সম্পর্কে বলেছেন, যৌন স্বাধীনতা পশ্চিমা সরকারগুলোর জন্য এমন একটি অস্ত্রে পরিণত হয়েছে যা দিয়ে তারা নৈতিক মূল্যবোধ ও পারিবারিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। তিনি বলেন, কোন নিয়ম-নীতি যখন সরকারের পক্ষ থেকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন কিছুদিন এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলে ধরা হয়। অনেক সময় এ ব্যাপারে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাও চলে যেটা পশ্চিমা সমাজে বর্তমানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে সমাজ ধ্বংসের মাধ্যমে সরকারের চাপিয়ে দেয়া নীতির দৈন্যতা ফুটে উঠবেই। উইলিয়াম গার্ডনারের মতে, মূলত পশ্চিমা সরকারগুলো পারিবারিক কাঠামো ধ্বংসের জন্য দায়ী হলেও সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু বিষয়ও এজন্য দায়ী। এক্ষেত্রে তিনি পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। স্কুলের কোমলমতি শিশুদেরকে পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে বেড়ে ওঠার শিক্ষা দেয়া উচিত হলেও দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের কোন পাঠ্য নেই। "পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" শীর্ষক বইয়ে পাশ্চাত্যের স্কুলগুলোর ভয়াবহ চিত্রের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানকার স্কুলে এলকোহল ও মাদক সেবন, আগ্নেয়াস্ত্র বহন এবং যৌন অনাচার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে উল্লেখ করে গার্ডনার প্রশ্ন করেছেন, এমন অবস্থা সৃষ্টি হলো কেন? এরপর এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতাকে গুরুত্বহীন বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং কোমলমতি সন্তানদেরকে পিতামাতার সাথে বেয়াদবী করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। গার্ডনারের বইয়ে আরো বলা হয়েছে, পাশ্চাত্যের স্কুলগুলোতে যৌনশিক্ষা বলে যে পাঠ্য চালু করে দেয়া হয়েছে, তা কোমলমতি শিশুদের যৌনাচারে উস্কে দিচ্ছে। কথিত ঐ যৌনশিক্ষা বিয়ে, পরিবার ও সমাজ ধ্বংসের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গার্ডনার আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, যৌনশিক্ষার নামে স্কুলে যা শেখানো হচ্ছে, তাতে বাচ্চাদের আর পর্নোগ্রাফি দেখার প্রয়োজন নেই। বয়ো:সন্ধিকালে শিশুরা আগে যেখানে পিতামাতার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতো, যৌনশিক্ষার মাধ্যমে এখন আর তারা সে প্রয়োজন অনুভব করছে না, নিজেরাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে পরিচালিত জনমত জরীপে দেখা গেছে, কথিত যৌনশিক্ষা চালু থাকার পরও অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ, গর্ভপাতসহ এ ধরনের অনৈতিক কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ার পরিবর্তে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কানাডিও লেখক গার্ডনারের মতে, পারিবারিক কাঠামো ধ্বংসের আরেকটি কারণ হচ্ছে ফেমিনিযম বা কথিত নারীবাদী আন্দোলন। তিনি এক্ষেত্রে উগ্র নারীবাদীদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যারা স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স গ্রহণ করে নারীদের সমকামী হতে উস্কে দিচ্ছে এবং তাদেরকে মা হতে নিষেধ করছে। তিনি নারীবাদীদের এ কাজের তীব্র বিরোধিতা করেন। গার্ডনার সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য হলেও সংসারে তাদের উপস্থিতি এবং সন্তান লালন পালনে তাদের ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশী উপকারী বলে মনে করেন। তিনি বলেন, আমি অতি খারাপ মায়ের চেয়ে শিশুদের ডে কেয়ার সেন্টারে পাঠানোকে শ্রেয় মনে করবো। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, একজন সাধারণ মায়ের জায়গা কেউই পূরণ করতে পারে না, আর মা যদি ভালো হয়, তাহলেতো আর কথাই নেই। উইলিয়াম গার্ডনার স্বাভাবিক ও ঐতিহ্যগত পারিবারিক কাঠামোর জন্য সমকামিতা এবং সমকামীদের মাধ্যমে পরিবার গঠনকে মারাত্মক হুমকি বলে মনে করেন। সমকামী আন্দোলনকারীরা যে সব লোকভোলানো কথা বলে, বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তা খণ্ডন করে তিনি বলেন, এই অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক যৌনাচার পরিবার, সমাজ- এমনকি সমকামীদের নিজেদের জন্যও বিপদজনক ও ক্ষতিকর। পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শীর্ষক বইয়ে পশ্চিমা সমাজের আরো যেসব অনাচারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তার মধ্যে গর্ভপাতের মাধ্যমে অঘোষিত জাতিগত শুদ্ধি অভিযান অন্যতম। গার্ডনার গর্ভপাতকে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে মনোরম প্রচারণার মাধ্যমে এ কাজে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, "একজন নারী ও একজন পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সন্তান ধারণের মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবার গঠন করেন। কিন্তু সমকামীরা যে কথিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় সেটা দুই পুরুষই হোক কিংবা দুই নারী- তাকে কোনভাবেই স্বাভাবিক পরিবার বলা চলে না। এছাড়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই দুই নারী পুরুষের একত্রে থাকাকেও পরিবার বলা যায় না, কারণ, এখানে কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। গার্ডনার তার বইয়ের শেষাংশে বলেছেন, পারিবারিক কাঠামোর ওপর যত হামলাই চালানো হোক না কেন, এ কাঠামো টিকে থাকবে। কারণ, পাশ্চাত্যে লোকভোলানো যেসব শ্লোগান দিয়ে পরিবার ধ্বংসের চক্রান্ত করা হচ্ছে, তা বেশীদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তিনি সুস্থ মস্তিস্কসম্পন্ন বিবেকবান মানুষদের পারিবারিক কাঠামো রক্ষার কাজে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।#