Monday, August 11, 2008

আরব বিশ্বের পানি সম্পদ জবর দখলের ইসরাইলী অপচেষ্টা

ইহুদীবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইহুদীবাদী নেতারা আরব দেশগুলোর পানি সম্পদ দখল ও তা প্রত্যাহার করে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে। এ কারণে আরব দেশগুলো বিশেষ করে ফিলিস্তিনী জনগণ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনের স্বশাসন কর্তৃপক্ষের পানি সম্পদ বিভাগের প্রধান ফজল কাউশ এ সম্পর্কে বলেছেন, ইসরাইলীরা জর্দান নদীর শতকরা ৪৫ ভাগ পানি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। ফজল কাউশ আরো বলেছেন, জর্দান নদীর ৮৫ কোটি কিউসেক পানির মধ্যে ফিলিস্তিনীরা মাত্র ৮ কোটি ৫০ লাখ কিউসেক পানি ব্যবহার করতে পারছে। ইহুদীবাদী ইসরাইল ঐ নদীর বাকি পানি বাঁধ দিয়ে প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে। এর আগে গাজা উপত্যকার ওপর ইসরাইলী দখলদারিত্বের সময় তেলআবিব গাজা থেকেও বেশীর ভাগ পানি চুরি করে নিয়ে যেত। গাজার পানি সম্পদের পরিমাণ বছরে ২০ কোটি কিউসেক বলে ধরা হয়। তবে গাজা থেকে ইসরাইলী সেনা প্রত্যাহার করার পর ইহুদীবাদীরা ঐ উপত্যকার পানিসম্পদ আর চুরি করতে পারছে না। কিন্তু ইহুদীবাদী ইসরাইল কর্তৃক জর্দান নদীর পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রয়েছে। সিরিয়া ও জর্দানের ভেতর দিয়ে বয়ে আসা নদী ইয়ারমুক থেকেও ইসরাইল বছরে ১০ কোটি কিউসেক পানি সরিয়ে নিচ্ছে। দক্ষিণ লেবানন যখন ইসরাইলের দখলে ছিল, তখন সেখানকার তিনটি নদীর পানি ইহুদীবাদীরা চুরি করতো এবং এর পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি কিউসেক। কিন্তু হিযবুল্লাহর তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে ২০০০ সালে ইহুদীবাদী সরকার দক্ষিণ লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরও তারা লেবাননের পানি চুরি করা বন্ধ রাখে নি। তারা খাল খনন ও পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে লেবাননের পানি ইসরাইলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। গোলান মালভূমি দখল করে ইহুদীবাদীরা সিরিয়ার ৬০ কোটি কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এদিকে ইসরাইলের বার্ষিক পানির চাহিদা ২০০০ সালে ছিল ২৩০ কোটি কিউসেক, যা ২০২০ সালে ৩১০ কোটি কিউসেকে গিয়ে দাঁড়াবে। কাজেই ইসরাইলের পানি চাহিদার এ হিসাব থেকে বোঝা যায়, অবৈধ ঐ রাষ্ট্রটি তার ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটানোর জন্য আগামী দিনগুলোতে আরব দেশগুলোর আরো বেশী পানির উৎস দখলের চেষ্টা করবে। তার তা করতে গেলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে। বর্তমানে ইসরাইল তুরস্কের বিভিন্ন নদী এবং মিশরের নীল নদ থেকে পানি আনার পরিকল্পনা মাথায় রেখেছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, ইহুদীবাদী ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে তার আগ্রাসী নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আরব দেশগুলোর পানিসম্পদ কূক্ষিগত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সিরিয়া, লেবানন ও জর্দানের পানি সম্পদের ওপর তেলআবিবের লোলুপ দৃষ্টি সব সময়ই ছিল। কথিত শান্তি আলোচনার মাধ্যমে যদি এসব পানির উৎসের নাগাল পাওয়া যায় তো ভালো, তা না হলে যুদ্ধ ও আগ্রাসনের মাধ্যমে এগুলো দখল করা ছিল ইসরাইলের অন্যতম নীতি। নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত ইসরাইলের সীমানা বিস্তৃত করার যে ধৃষ্ঠতাপূর্ণ ঘোষণা ইহুদীবাদী নেতারা দিয়েছিল, তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আরব দেশগুলোর পানি সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, শুধুমাত্র ভৌগোলিক সীমানা বৃদ্ধি করার জন্য নয়, সেই সাথে আরব দেশগুলোর পানি সম্পদের ওপরও জবর দখল প্রতিষ্ঠা করা ছিল নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত ইসরাইলের সীমানা বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত ঘোষণার অন্যতম উদ্দেশ্য। ওয়ার্ল্ড ওয়াটার রিসার্স সেন্টারের অন্যতম গবেষক রোস্টভা এ সম্পর্কে বলেছেন, ইসরাইল তার পতাকায় সাদা ভূমির ওপর যে নীল রংয়ের তারকা চিহ্ণ এঁকেছে, তার মধ্যেও আরবদের পানি সম্পদ কূক্ষিগত করার বাসনা লুকিয়ে আছে। ঐ নীল রংয়ের দাগগুলো হচ্ছে নীল ও ফোরাত নদীর কাল্পনিক প্রতীক। ইহুদীবাদী নেতাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে ওয়ার্ল্ড ওয়াটার রিসার্স সেন্টারের ঐ গবেষকের কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইহুদীবাদী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্তযেল যখন মধ্যপ্রাচ্যের বুকে একটি বৃহৎ ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল, তখন অন্য সব কিছুর আগে সে কল্পিত ঐ রাষ্ট্রের পানি চাহিদা কীভাবে মেটানো হবে, সে বিষয়টি মাথায় রেখেছিল। হার্তযেল ১৮৮৬ সালে নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত বিস্তৃত ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিল, ভবিষ্যতে যারা ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করবে তাদের নেতৃত্বে থাকবে পানি বিষয়ক কিছু বিশেষজ্ঞ। ঐ ইহুদীবাদী নেতা ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাল শহরের বিখ্যাত সম্মেলনে বলেছিল, ইসরাইলের সীমান্ত আগামী ৫০ বছর নাগাদ উত্তর লিথুনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বিন গোরিওন ১৯৫৫ সালে ইসরাইলের পানির উৎস সম্পর্কে বলেছিল, বর্তমানে ইসরাইল- পানি সম্পদের উৎস দখল করার জন্য আরবদের সাথে যুদ্ধ করছে। কাজেই এ যুদ্ধের ফলাফলের ওপর ইসরাইলের ভবিষ্যত অস্তিত্ব সরাসরি নির্ভরশীল। বিন গোরিওন আরো বলেছিল, আরবদের সাথে ঐ যুদ্ধে পরাজিত হলে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইসরাইলের আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। ইসরাইলের একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়েবেন এ সম্পর্কে বলেছেন, ইহুদীবাদী ইসরাইলের দৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যে সেদিনই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, যেদিন আরব দেশগুলোর সকল পানি সম্পদের ওপর তেলআবিবের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।