যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় :
স্টকহম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সিপরির বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে একজন মানুষের পেছনে সামরিক খাতে ব্যয় হয় ২০২ ডলার করে ৷ গত এক দশকে দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৪৫ ভাগেরও বেশী ৷
গোটা বিশ্বে যখন বেড়ে চলেছে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সংখ্যা, ঠিক তখন তার চেয়েও বেশী গতিতে বেড়ে চলেছে গোটা বিশ্বের সামরিক ব্যয়৷ সুইডিস সংস্হা স্টকহম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট সিপরি তার বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে গত এক দশকে বিশ্বের সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৪৫ ভাগেরও বেশী৷
এর মধ্যে কেবল গত বছরেই বেড়েছে ৬ ভাগ৷ সুইডিস সংস্হার হিসেব মতে গত বছর সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষা অভিযানের সংখ্যা ছিলো ৬১টি৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এ সময়ের মধ্যে দেশগুলো সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১৩শ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের বেশী যা মোট জিডিপির আড়াই শতাংশ৷ গড়ে একজন মানুষের পেছনে সামরিক ব্যয় হয়েছে ২০২ ৷
সুইডিস সংস্হার হিসেব মতে, গত বছর বিশাল অংকের এ সামরিক ব্যয়ের ৪৫ ভাগই করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার পরিমাণ ৫৪৭ বিলিয়ন ডলার৷ এর পরই রয়েছে ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স ও জাপান৷
যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা :
অস্ত্র বেচা-কেনা,বর্তমান বিশ্বের জমজমাট ব্যবসাগুলোর মধ্যে অন্যতম ৷ বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই এই ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে ৷ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অস্ত্র বাজারে মার্কিন প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হোয়াইট হাউজ, ছয় হাজার সাতশ কোটি ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করে,যা তৎকালিন বিশ্ব বাজারে মোট অস্ত্র বিক্রির ৫৫ শতাংশ ৷ ২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার মধ্য দিয়ে পেন্টাগনের জন্য আরেকটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং হোয়াইট হাউজ, ১১ ই সেপ্টেম্বরের অজুহাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আরও বেশি পরিমাণে অস্ত্র কিনতে উৎসাহিত করে ৷
নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করে ৷ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অস্ত্র ক্রয়ের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা আরও জমজমাট হয়ে ওঠে ৷ বিশেষকরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে অস্ত্র কেনার হিড়িক পড়ে যায় ৷ এর ফলে ২০০২ ও ২০০৩ সালে বিশ্বের সামরিক ব্যয় প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায় ৷ ২০০১ সালের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার কোটি ডলার থেকে ১ হাজার তিনশ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে ৷ ২০০৬ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার একশ কোটি ডলারে পৌছেছে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক ৷
২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ত্র বিক্রির মাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের অনেক দেশের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং ২০০৬ সালে এ ধরনের দেশের সাথে সবচেয়ে বেশি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ৷ যে সব দেশের ওপর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে, সেগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, সার্বিয়া, আযারবাইজান, আর্মেনিয়া ও তাজিকিস্তান অন্যতম ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে ৷ এর মধ্যে একটি হলো, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ উস্কে দেয়া এবং নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করা ৷ বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও হানাহানি বৃদ্ধি মানেই অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠা ৷ এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পেন্টাগন,ভারত-পাকিস্তান, তুরস্ক-গ্রীস এবং আযারবাইজান-আর্মেনিয়ার মতো চীর বৈরি দেশগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র বিক্রি করে থাকে ৷ মধ্যপ্রাচ্যে, ইসরাইল সৃষ্টি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ইসরাইলের আগ্রাসনকেও এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে৷ মধ্যপ্রাচ্যে, ইসরাইলের যুদ্ধংদেহী অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ সৌদি আরব ও মিশর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করলেও শক্তির ভারসাম্য কখনোই সৃষ্টি হয় নি ৷ এর কারণ হলো, ইসরাইলের সম্মতি ছাড়া পেন্টাগন, আরব দেশগুলোকে অত্যাধুনিক কোন অস্ত্র সরবরাহ করে না ৷ এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলকে প্রতি বছর তিনশ কোটি ডলার সাহায্য দিয়ে থাকে, যার বেশির ভাগই অস্ত্র কেনার জন্য খরচ করা হয় ৷
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাস্তব ভীতি সৃষ্টি করে ৷ যুক্তরাষ্ট্র, তার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করে যে, সামনে মহা বিপদ অপেক্ষা করছে এবং তা মোকাবেলার জন্য আরও বেশি অস্ত্র কিনতে হবে ৷ ওয়াশিংটন, হুমকির জুজু ব্যবহার করে এ পর্যন্ত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে৷ ১৯৯০ সালে সাদ্দাম, কুয়েতের ওপর হামলার পর সাদ্দাম ভীতিকে বড় করে তুলে ধরার মাধ্যমেও এসব দেশে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে ৷
পারস্য উপসাগরের দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশগুলো বিপুল তেল সম্পদের অধিকারী হবার কারণে এসব দেশের প্রতি সব সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র উৎপাদনকারীদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে ৷ বিশেষ করে তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর নতুন করে এসব দেশের প্রতি পেন্টাগনের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে ৷ এ কারণে গত কয়েক বছরে আরব দেশগুলোর তেল খাত থেকে অর্জিত অর্থের একটা বড় অংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর পকেটে ঢুকেছে৷ কিন্তু বাস্তবে এত বিপুল অর্থ দিয়ে কেনা এসব অস্ত্র কোন কাজে আসেনি এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর এসব অস্ত্র ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট রাখার জন্য মাঝে মধ্যেই কল্পিত শত্রু সৃষ্টি করে এবং মার্কিন কর্মকর্তারা ঘন ঘন এসব দেশ সফরের মাধ্যমে কোন একটি দেশকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরে আরও উন্নত অস্ত্র কেনার জন্য উৎসাহিত করে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার ইরানকে এসব দেশের জন্য হুমকি হিসেবে প্রচার করছে৷ কিন্তু বাস্তবে ইরান এসব দেশের জন্য কোন হুমকি তো নয়ই বরং তেহরান, পারস্য উপসাগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বহু দিন ধরেই আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে ৷
অস্ত্র কেনাটাই কিন্তু শেষ কথা নয় ৷ এসব অস্ত্রের জন্য পরবর্তীতে বিভিন্ন যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়, আর এসব যন্ত্রাংশেরও যোগান দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৷ এছাড়া, এসব অস্ত্র আমদানির পর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার উপযোগী করার জন্য মার্কিন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় ৷ মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে এসব অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণও দিতে হয় ৷ ফলে এজন্যেও আমদানি কারক দেশের বিপুল অর্থ খরচ হয়৷ এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি এসব দেশকে নিজের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে ৷ এছাড়া, উন্নত অস্ত্র বিক্রির শর্ত হিসেবে এসব দেশের ওপর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয় ৷ উদাহরণ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে ৷ এই দেশটি প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার দিয়ে ৮০ টি এফ-সিক্সটিন জঙ্গী বিমান কেনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজ ভূখন্ডে সামরিক ঘাটি নির্মাণের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট রাখার জন্য অনায়াসেই নিজের ঘোষিত মানদন্ড ও নীতি লংঘন করছে ৷ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের অগ্রনায়ক হিসেবে ঘোষণা করলেও পরক্ষণেই বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে নিজের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় ৷ এসব দেশকে অগণতান্ত্রিক, মানবাধিকার লংঘনকারী ও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্ণিত করে হোয়াইট হাউজই এসব দেশের বিরুদ্ধে এর আগে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের ফেডারেশন, হোয়াইট হাউজের দ্বিচারিতা সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে বলেছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে যেসব দেশকে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশ দেশই সন্ত্রাসবাদকে লালন করে ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব স্ববিরোধী আচরনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায় ৷ এছাড়া মার্কিন অস্ত্র উৎপাদনকারীদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখাও হোয়াইট হাউজের একটি বড় লক্ষ্য ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টির সাথে অতীত কাল থেকেই দেশটির অস্ত্র কোম্পানিগুলোর ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে এবং একারণেই হোয়াইট হাউজ, হালকা অস্ত্র বিক্রি সীমাবদ্ধ করার ব্যাপারে জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ৷ একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার অস্ত্র নির্মাণ শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্যে বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষের জীবন ও সম্মান-মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করছে এবং যেখানেই প্রয়োজন হচেছ যুদ্ধ-বিগ্রহ উস্কে দিচেছ৷ ফলে বিশ্বের বর্তমান অস্থিতিশীল ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির জন্য হোয়াইট হাউজই অনেকাংশে দায়ী ৷